পরিণাম নিয়ে আশঙ্কা দলেই

দোলার হারের জেরে মন্ত্রিত্ব গেল মলয়ের

বিজেপির কাছে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে দলের হারের মাসুল দিতে হল কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটককে। দলনেত্রীর তিরস্কারের মুখে পড়ে মন্ত্রিত্ব এবং তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতির পদ থেকে তিনি ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন বলে দলের একটি সূত্রের খবর। প্রশাসনিক সূত্রেও এমন খবরের সমর্থন মিলেছে। ওই সূত্রে বলা হচ্ছে, সোমবার রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে মলয়বাবুর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি ভাবে তৃণমূলের তরফে অবশ্য এই খবরের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

বিজেপির কাছে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে দলের হারের মাসুল দিতে হল কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটককে। দলনেত্রীর তিরস্কারের মুখে পড়ে মন্ত্রিত্ব এবং তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতির পদ থেকে তিনি ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন বলে দলের একটি সূত্রের খবর। প্রশাসনিক সূত্রেও এমন খবরের সমর্থন মিলেছে। ওই সূত্রে বলা হচ্ছে, সোমবার রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে মলয়বাবুর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি ভাবে তৃণমূলের তরফে অবশ্য এই খবরের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। আর এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে না চাওয়া মলয়বাবুর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “খবর ভাল নয়।”

Advertisement

আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে এ বার বিজেপির বাবুল সুপ্রিয়র কাছে ৭০ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন মমতার আস্থাভাজন, তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেন। শ্রমিক নেত্রী দোলার নাম ঘোষণা করার সময় থেকেই আসানসোলে তৃণমূলের অন্দরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। বহিরাগত কাউকে প্রার্থী না করার জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে বার্তা পাঠাতে থাকেন স্থানীয় নেতারা। কিন্তু সেই বার্তা উপেক্ষিতই হয়।

আসানসোলে নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জেলা সভাপতি মলয়বাবুকেই। কিন্তু দোলার জন্য এলাকার নেতা-কর্মীদের সকলে যে পূর্ণ উদ্যমে মাঠে নামছেন না, তা আঁচ করে একাধিক বার আসানসোলে সভা করতে গিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে আসেন মমতা। তার পরেও দোলাকে হারতে হয়। এবং দেখা যায়, মলয়বাবুর নিজের কেন্দ্র আসানসোল উত্তরে তো বটেই ওই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত যে পাঁচটি বিধানসভা তৃণমূলের হাতে আছে, তার সব ক’টিতেই বিজেপির থেকে কম ভোট পেয়েছেন তিনি!

Advertisement

তৃণমূল সূত্রে খবর, ফল বেরেনোর পরেই মলয়বাবুর উপরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মমতা। প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি মলয়বাবুকে ইস্তফা দিয়ে দেওয়ার জন্য বার্তা পাঠান। পর দিনই কলকাতা ছুটে আসেন কৃষিমন্ত্রী। তৃণমূলের তরফে সরকারি ভাবে স্বীকার করা না হলেও দলীয় সূত্র বলছে, সেই দিনই সুব্রতবাবুর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেন মলয়বাবু। তার পর প্রথম কাজের দিন, সোমবার সেই চিঠি পাঠানো হয়েছে রাজ্যপালকে। মমতা তাঁকে জানিয়েছেন, কৃষি দফতর আপাতত নিজের হাতেই রাখছেন তিনি।

আসানসোল ও কুলটি পুরসভার ভোটের আগে এই ঘটনায় যথেষ্ট চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে তৃণমূল শিবিরে। দলীয় সূত্রের খবর, আসানসোল শিল্পাঞ্চলকে মলয়ের প্রভাব-মুক্ত করতে চাইছেন মমতা। বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) যুব তৃণমূল সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মলয়বাবুর ভাই অভিজিৎ ঘটককেও। এই সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করে যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “দলের বর্ধমানের যুব নেতা অশোক রুদ্রকে ওই পদে বসানো হচ্ছে।” তবে অভিজিৎবাবুকে আসানসোলের মেয়র পারিষদ পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলা হচ্ছে না বলেই তৃণমূল সূত্রে খবর।

অভিজিৎবাবু অবশ্য এ দিন বিকেলে দাবি করেন, “দলের তরফে আমি এখনও কোনও নির্দেশ পাইনি।” অভিজিৎবাবুকে সরিয়ে দেওয়ার খবরে খানিকটা বিস্মিত তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল। তাঁদের বক্তব্য, অভিজিৎবাবু এ বার কোনও বিধানসভা এলাকার দায়িত্বে ছিলেন না। আসানসোলে তৃণমূল মাত্র যে পাঁচটি ওয়ার্ডে বিজেপি-র থেকে বেশি ভোট পেয়েছে, তার একটি অভিজিৎবাবুর এলাকা।

মলয়বাবুর বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ মূলত চার দফা। প্রথমত, দোলার প্রার্থী-পদ তিনি একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে কৃষিমন্ত্রী এমনও বলেছিলেন, মন্ত্রিত্ব গেলে যাক! কিন্তু দোলাকে তিনি কিছুতেই জিততে দেবেন না। দলের একাংশের বক্তব্য, ওই আসনে নিজে লড়ার বা ভাইকে দাঁড় করানোর ইচ্ছা ছিল মলয়বাবুর। দ্বিতীয়ত, বিজেপির গায়ক-প্রার্থী বাবুলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে অভিযোগ-সহ একাধিক মামলা দায়ের করাটা জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। তৃণমূলের উপর মহলের পরামর্শ ছিল, এমন অভিযোগ না তোলাই ভাল। কিন্তু মলয়বাবু ও তাঁর অনুগামীরা তা কানে তোলেননি। তৃতীয়ত, ভোটের দিন আসানসোল লোকসভার মাত্র ১৫-২০% বুথে বিজেপির এজেন্ট ছিল। বিজেপি-কে নিয়ে জনগণ এমন কিছু উদ্বেল ছিল না বলেই তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি। তাঁদের মতে, এই অবস্থায় তৃণমূলের একাংশের মদত না থাকলে বাবুল সুপ্রিয় জিততে পারতেন না। এবং চতুর্থত, ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, আসানসোলে তিন জন নির্দল প্রার্থী প্রায় ২৯ হাজার ভোট পেয়েছেন। মলয়বাবুর অনুগামীরাই ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাঁদের ভোট পাইয়ে দিয়েছেন বলে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের অভিযোগ।

এই সব অভিযোগ সম্পর্কে অবশ্য মলয়বাবুর বক্তব্য জানা যায়নি। ‘খবর ভাল নয়’ এই সংক্ষিপ্ত, তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছাড়া বিষয়টি সম্পর্কে মুখই খুলতে চাননি তিনি। তৃণমূলের তরফেও গোটা ঘটনাটি সম্পর্কে একটা সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি করে রাখা হয়েছে। এর কারণ স্পষ্ট না হলেও মলয়বাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে দলের একাংশের মধ্যে যে অস্বস্তি রয়েছে তা তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। এই নেতাদের মতে, মোদী-হাওয়ায় রাজ্যে বিজেপির উত্থান ঘটেছে। এখন আচমকা কারও বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ করলে তিনি বিজেপির দিকে চলে যেতে পারেন।

মলয়বাবুর বাবা লাবণ্যপ্রভ ঘটক ছিলেন আসানসোলে কংগ্রেসের শ্রমিক নেতা। আগাগোড়া কংগ্রেস পরিবারের সন্তান মলয় তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে মমতার দলে আছেন। সুবিধামতো জার্সি বদল করেননি। তাঁর এই পরিণতি দেখে সহকর্মীদের অনেকেই ব্যথিত। দলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, “মলয় তৃণমূলের দুর্দিনে আসানসোলে পার্টিটা করেছে। অথচ এমন লোকজনের জন্য তাঁকে বলি দেওয়া হচ্ছে, যাঁরা তৃণমূলের সুদিনে এসে দলে কর্তৃত্ব করছেন!” প্রসঙ্গত, মমতা-জমানায় এই নিয়ে দ্বিতীয় কৃষিমন্ত্রীর ইস্তফার ঘটনা ঘটল। এর আগে দলে বিদ্রোহ করতে গিয়ে কৃষি দফতর থেকে সরতে হয়েছিল সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে।

আগামী জুলাইয়ে আসানসোল ও কুলটি পুরবোর্ডের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মলয়বাবুর ইস্তফা কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেই পুরভোটে? জেলার কিছু তৃণমূল নেতার বক্তব্য, আসানসোল শিল্পাঞ্চলে সংগঠন দাঁড় করানোর পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে মলয়বাবুর। খনি ও নানা কল-কারখানায় দলের শ্রমিক সংগঠনও কার্যত হাতে ধরে গড়ে তুলেছেন তিনি। অন্য দল থেকে বহু নেতা-কর্মী তাঁর হাত ধরেই তৃণমূলে এসেছেন। তার উপরে লোকসভার ফলের নিরিখে আসানসোল পুরসভার ৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৫টিতেই বিজেপি-র থেকে পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল। মলয়বাবু যদি দল বদল করেন বা সে ভাবে মাঠে না নামেন, পুরভোটেও দল বিপাকে পড়তে পারে।

তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, মলয়বাবুর পাশাপাশি আসানসোলের আর এক বিধায়ক তথা মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুলটির বিধায়ক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়কেও ইস্তফার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে। কারণ, এই তিন জনের এলাকাতেই বড় ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছিলেন দোলা। তাপসবাবু ও উজ্জ্বলবাবু অবশ্য এ দিনও জানান, তাঁরা এখনও কোনও নির্দেশ পাননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement