মণ্ডপে ব্যস্ত শিল্পী রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
এ যেন যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ানো!
আত্মপ্রত্যয়ে অটল, তুলির টানে, শিল্পের কাছে ফেরা। রামপুরহাটের দেশবন্ধু রোড সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ষাট ছুঁই ছুঁই শিল্পী রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের তুলির টানে ক্ষিপ্র গতি দেখে তেমনই মনে হচ্ছিল। কাজের মাঝে ঘুরে দাঁড়িয়ে চশমাটা ঠেলে এগিয়ে এলেন। চেনা মুখ দেখে হাসলেন, কুশল বিনিময়।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আলোটা বাড়িয়ে দিলে কি খুব অসুবিধে হবে? কম আলোয় চোখে তেমন ঠাওর হয় না!’’ কে বলবে অগ্নাশয় ক্যান্সার!
শেষ কাজ সেই রোগ ধরা পড়ার আগে। তার পর কোথা দিয়ে কী হল! টাকার জোগাড়, সংসারের চিন্তা! সে সব বলতে বলতেই রবিশঙ্করবাবু দেশবন্ধু রোড সর্বজনীন দুর্গাপুজা কমিটির উপর কৃতজ্ঞতার কথা বলছিলেন। অসুস্থ শিল্পীর পাশে দাঁড়াতে তাঁরাই এগিয়ে এসেছেন। প্রতিষ্ঠিত মৃৎশিল্পীর পাশে দাঁড়াতে অভিনব পরিকল্পনাও নিয়েছেন। ঠিক করেছেন, পারিশ্রমিক তো দেবেনই, মণ্ডপসজ্জায় যে শিল্পসামগ্রী তৈরি করছেন রবিশঙ্করবাবু, তা-ও নিলামে বিক্রি করা হবে। পুজোর বাজেটের একটি অংশ শিল্পীর চিকিৎসার জন্যও ব্যয় করবেন।
মণ্ডপসজ্জা দেখতেই দেখতেই কথা হচ্ছিল রবিশঙ্করবাবুর সঙ্গে। স্থানীয় আখিড়া গ্রামের বাসিন্দা শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় মিশরীয় ভাস্কর্যের আদলে রূপ পেয়েছে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, মহিষাসুর। মণ্ডপের দেওয়ালে কাঠের বোর্ডে ফুটে উঠছে মিশরীয় সভ্যতার নানা নির্দশন। পুজোর দিন ঘনিয়ে আসতেই ক্রমশ এক এক করে বারোটি বোর্ড মণ্ডপের ভিতরে-বাইরে জায়গা করে নেবে।
দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদক কমল বিশ্বাস বলেন, ‘‘রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় গুণী মৃৎশিল্পী। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দেড় বছর বাড়িতে বসেই দিনযাপন করছিলেন। কাজের জন্য ডাকও পাচ্ছিলেন না। আমাদের পুজো কমিটিও উদ্যোক্তার অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।’’ এই অবস্থায় ওয়ার্ডের নতুন কাউন্সিলর জামালউদ্দিন শেখই পুজো করার উৎসাহ জোগালেন। ‘‘আর তখনই রবিশঙ্করবাবুর কথা মাথায় এল। এক কথায় রাজিও হয়ে যান তিনি,’’—বলছেন কমলবাবু।
খড়, মাটি, রং-তুলিতে এখন মগ্ন রবিশঙ্করবাবু। দু’কথা এগোতেই রোগের প্রসঙ্গ উঠল। ফিরে আসার আগে, ‘ভাল থাকবেন’ বলতেই চোখের জল বাগ মানাতে পারলেন না শিল্পী। হাতের চেটোয় চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘সেই কোন ছ’বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে কাজ করছি। মণ্ডপের-মূর্তির কত জাঁক, কত পুরস্কার! আজ আর কেউ ডাকে না! ছেলেই সংসার চালাচ্ছে। জানি না, আর কত দিন পারব!’’ দেশবন্ধু রোড সর্বজনীন বলছে, রবিশঙ্করবাবু থামবেন না!