প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পেয়ে গেলেন মহম্মদ সেলিম!
তক্কে তক্কে ছিলেন কবে সুযোগ আসে। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুকথার দৌলতে তা এসেও গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ে তাপস পালকে এক হাত নেওয়ার সুযোগ আজ হাতছাড়া করেনি সিপিএমের এই সাংসদ। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গিয়ে বিজেপির সঙ্গে গা মাখামাখি করে ফেলেছেন! গত হপ্তায় তাপস পালের হাত ধরেই ধর্নায় দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন! শেষ মুহূর্তে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য না আটকালে এত দিনে বঙ্গ-সিপিএমের ডায়েরিতে আরেকটি ‘ফিশ-ফ্রাই’ কাণ্ড যোগ হয়ে যেত!
নিজেকে আগমার্কা তৃণমূল বিরোধী প্রমাণ করতে সেলিম আজ রাজনৈতিক ছোঁয়াছুঁয়ির বালাই না রেখে বিজেপির সঙ্গে কাঁধ মেলাতেও দ্বিধা করেননি। বিজেপি সাংসদরা নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যের নিন্দা করেছেন। সেলিমও তাতে সায় দিয়ে জানিয়েছেন, নিন্দা প্রস্তাব আনা উচিত। সেলিমের আসল উদ্দেশ্য ছিল, কল্যাণকে আক্রমণ করে তাপস পালের প্রসঙ্গ টেনে আনা। তাপসের ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করানো’ মন্তব্যের সমালোচনা করা। যাতে আগের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। তা তিনি করেওছেন। তবে বিজেপিকে সঙ্গী করে।
অপ্রত্যাশিত ভাবে সেলিমকে পাশে পেয়ে বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য খুশি। সংসদে কমিউনিস্ট পার্টির কোনও নেতা নিজে থেকে বিজেপির পাশে দাঁড়াতে চাইছেন, এ ঘটনা বিরল। ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতারা অবশ্য সেলিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। কারণ গত সপ্তাহে তিনি বিজেপির সাধ্বী নিরঞ্জনের কুকথার নিন্দা করতে গিয়ে তৃণমূলের হাত ধরতে যাচ্ছিলেন। এই সপ্তাহে তৃণমূলের কুকথার সমালোচনা করতে গিয়ে হাত ধরেছেন বিজেপির। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সেলিম কি ভারসাম্য রাখতে পারছেন না? তৃণমূল নেতাদের আবার কটাক্ষ, এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বড় শত্রু না বিজেপি বড় বিপদ এটাই ঠিক করতে পারছে না আলিমুদ্দিন! সেলিমের মধ্যেও সেই বিভ্রান্তিই ফুটে উঠেছে। এক তৃণমূল সাংসদের বক্তব্য, এই কারণেই আজ যন্তর মন্তরে অম্বিকেশ মহাপাত্র-মৌসুমী কয়ালদের ‘আমরা আক্রান্ত’-র মঞ্চে বাবুল সুপ্রিয়-র পাশে দাঁড়িয়ে মমতার সরকারের সমালোচনা করেছেন সেলিম।
তৃণমূলকে আক্রমণ করতে গিয়ে সেলিমের বিজেপি প্রীতির খবর শুনে ঢোঁক গিলেছেন সীতারাম ইয়েচুরি। সেলিমের ভুলের জন্যই পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত এই রাজ্যসভার সাংসদকেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে ধমক খেতে হয়েছিল। ইয়েচুরি আজ তাই আর ও পথ মাড়াননি। বিজেপির থেকে দূরত্ব রাখার নীতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, কুকথা নিয়ে বিজেপিও দ্বিচারিতা করছে। ইয়েচুরির কথায়, “বিজেপি এত দিন রাজ্যসভায় মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জনের মন্তব্যের নিন্দা প্রস্তাবে রাজি হচ্ছিল না। এখন তারাই লোকসভায় অন্য দলের সাংসদের মন্তব্যে নিন্দা প্রস্তাব আনতে চাইছে! এটা দ্বিচারিতা।”
আজ কল্যাণের কদর্য ভাষার নিন্দা করেন দার্জিলিংয়ের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। প্রসঙ্গ ছিল হুগলির চণ্ডীতলায় নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে কল্যাণের মন্তব্য। সেলিম উঠে দাঁড়িয়ে সটান ঘোষণা করেন, তিনি বিজেপির সঙ্গী হচ্ছেন। মোদী সম্পর্কে কল্যাণের মন্তব্যের নিন্দা করে অহলুওয়ালিয়া প্রস্তাব আনার হুমকি দিয়েছিলেন। সেলিম আর এক কাঠি এগিয়ে মত দেন, স্পিকারের ভর্ৎসনা করা উচিত। না হলে লোকসভার নেতা বা সংসদীয় মন্ত্রী প্রস্তাব আনুন। অন্যথায় এই সাংসদদের দুঃসাহস বেড়ে যাবে।
এর পরেই তাপস পাল প্রসঙ্গে চলে যান তিনি। সাধ্বী নিরঞ্জনের বিরুদ্ধে ধর্নায় গিয়ে তাপসের শাস্তির দাবি করবেন না বলে সে দিন জানিয়েছিলেন। আজ সেই সেলিমই বলেছেন, তাপস পালের মতো সাংসদদের সঙ্গে একই সভায় থাকলে সকলেরই ভাবমূর্তি নষ্ট হবে! স্পিকারকে সেলিম বলেন, “মন্ত্রীরা প্রায়ই তাঁদের বক্তৃতায় প্রসঙ্গ টেনে বলেন, তাপস পাল এই বলেছিলেন, সিপিএমের সদস্যদের অত্যাচার করার কথা বলেছিলেন। এ বিষয়ে আমি চিঠি লিখলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আপনাকে সাহস করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা হলেই এই দুঃসাহস রোখা যাবে।” সেলিমের যুক্তি, প্রথমে কারও নাম করে, তার পর বাবার নাম করে, তার পর দাদু-ঠাকুমার নাম করে কুকথা বলা হচ্ছে। এতে সংসদের মর্যাদাই ধুলোয় মিশছে। এর নিন্দায় প্রস্তাব আনাটাই সংসদের পরম্পরা।
সংসদের চার তলায় সিপিএমের সংসদীয় দলের দফতরে এখন চিন্তার হাওয়া। মোদী সম্পর্কে কল্যাণের কুকথায় বিজেপি সত্যিই নিন্দা প্রস্তাব আনলে সিপিএম কোন দিকে দাঁড়াবে? বিজেপি না তৃণমূল? বাম সূত্রের ইঙ্গিত, নিজেকে প্রমাণ করতে আগামিদিনে তৃণমূলের আরও নিন্দা করার পরিকল্পনা রয়েছে সেলিমের। যা শুনে তৃণমূলের এক নেতার কটাক্ষ, “সেলিম আজ গেরুয়াপন্থী হয়ে প্রমাণ করলেন তিনি বামপন্থীই রয়েছেন!”