বাংলা তাঁদের পাখির চোখ। দিল্লি থেকে তাঁরা যে কোনও প্রয়োজনেই বাংলার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবেন। দিল্লি বা ভারতের নানা প্রান্ত থেকে নানা নেতাকে উড়িয়েও আনবেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও মূল কথা একটাই সংগঠন! দলের সংগঠনের জোর না থাকলে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দুরূহ হয়ে পড়তে পারে। রাজ্য ও জেলা স্তরের নেতাদের সঙ্গে দু’দফার বৈঠকে মঙ্গলবার এই সহজ পাঠই দিয়ে গেলেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।
বস্তুত, ডিম আগে না মুরগি আগে এই চিরাচরিত দ্বন্দ্বের কথাই এ যাত্রায় অমিত মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁর সহকর্মীদের। তাঁর যুক্তি, দলের অনেকে হয়তো ভাবছেন মানুষের সমর্থন পেয়ে রাজ্যে সরকার গড়তে পারলে সংগঠন বাড়ানোর কাজ আপনা থেকেই হবে! কিন্তু সংগঠন না থাকলে কি সমর্থন পাওয়ার জন্য মানুষের কাছে যাওয়া সম্ভব? এই প্রশ্ন তুলে দলের অন্দরে নিজেই উত্তর দিয়েছেন সর্বভারতীয় সভাপতি। বুঝিয়েছেন, দু’টো কাজ আসলে একে অপরের পরিপূরক। রাজ্যে যতই তৃণমূল-বিরোধী হাওয়া উঠুক, শাসক দল যতই অপকর্ম করুক, সংগঠন ছাড়া তার সম্পূর্ণ ফায়দা তোলা কঠিন। তাই সংগঠন বাড়াতে সদস্য সংগ্রহ অভিযানে ফাঁকি দেওয়া চলবে না।
রাজ্য সফরে এসে এ দিন অমিত বর্ধমানে তাঁর দলের নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি বসেছিলেন দু’দফায়। প্রথমে বর্ধমানে পৌঁছে ‘সংস্কৃতি’ মঞ্চে দলের রাজ্য কার্যনির্বাহী সমিতির বৈঠক। পরে জনসভা সেরে জেলা পরিষদ ভবনে বর্ধিত রাজ্য কমিটির বৈঠক, যেখানে ছিলেন সব জেলা সভাপতি, জেলার সাধারণ সম্পাদক এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। দুই বৈঠকেই জেলা ধরে ধরে সদস্যপদ অভিযানের খতিয়ান নিয়েছেন অমিত। এর আগে তিনিই পশ্চিমবঙ্গের জন্য ১ কোটি সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত সদস্য পদে নাম পাওয়া গিয়েছে ১৪ লক্ষ। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সদস্য নথিভুক্তির এই গতি অমিতদের সন্তুষ্ট করছে না ঠিকই। কিন্তু বিজেপি সূত্রের খবর, তার জন্য দলের রাজ্য বা জেলা নেতাদের এ দিন একতরফা তিরস্কার করেননি অমিত। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “সভাপতি বুঝিয়ে দিয়েছেন, লোকসভা ভোটের আগে গত বছর যেখানে রাজ্যে আমাদের সদস্য ছিল প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার, অত্যন্ত দ্রুত সেটা ১৪ লক্ষে পৌঁছেছে। সভাপতির বক্তব্য, তা হলে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে সদস্যসংখ্যা কেন অন্তত ৭০-৭৫ লাখে নিয়ে যাওয়া যাবে না?”
সদস্য সংগ্রহ করার জন্য মোবাইলে মিস্ড কল, এসএমএসে যোগাযোগের মতো অভিনব প্রথা এ বার চালু করেছে বিজেপি। অমিত নিজে বা এ রাজ্যে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরা এ দিনও জনসভা থেকে বারবার আবেদন করেছেন, “মোবাইলটা বার করে একটা মিস্ড কল করুন। কোনও পয়সা কাটবে না। আমরাই আপনার কাছে নরেন্দ্র মোদীর বার্তা পৌঁছে দেব!” বাইরে এই চমকপ্রদ এবং সহজ পদ্ধতির উপরে জোর দেওয়ার পাশাপাশিই দলের অন্দরের বৈঠকে কিন্তু অমিত বলেছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোককে রাজি করানোর পরিশ্রমও করতে হবে। দলের এক জেলা নেতার কথায়, “অমিতজি বলেছেন, ১০টা লোকের সঙ্গে কথা বলা হলে তাদের মধ্যে ৮টা নাম সদস্যপদের খাতায় তুলতে হবে।”
এক দিকে যেমন দলের কলেবর বৃদ্ধি, তেমনই বুথ স্তরে বাহিনী তৈরির উপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন অমিত। তাঁর বার্তা, প্রতি বুথে অন্তত ১০০ সদস্য না থাকলে ভোটে ঠিকমতো লড়াই দেওয়া মুশকিল। ওই ১০০ জনের মধ্যে অন্তত দু’জনকে হতে হবে সর্বক্ষণের কর্মী (যাঁদের বলা হচ্ছে ‘বুথ বাহাদুর’)। প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র ধরে ধরে বুথরক্ষা বাহিনী গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে এ দিন ফের নির্দেশ দিয়েছেন সর্বভারতীয় সভাপতি। এর আগেও কলকাতায় দলের নেতাদের নিয়ে বসেছেন অমিত। কিন্তু জেলা স্তরের নেতাদের সঙ্গে এতটা বিস্তারিত ভাবে মত বিনিময় এই প্রথম। এই কাজে সময় দিতেই রাতে বর্ধমান থেকে ফিরে কলকাতায় থেকে গিয়েছেন অমিত। ফিরে যাবেন আজ, বুধবার সকালে।
দ্বিতীয় দফার সাংগঠনিক বৈঠকে এ দিন জেলার নেতাদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল সর্বভারতীয় সভাপতির কাছে। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও কলকাতার প্রতিনিধিরা যেমন জানতে চেয়েছিলেন, সীমান্তে গরু পাচার বন্ধ করার উপায় কী? অমিত জানিয়েছেন, সংগঠন গড়ে তুলে মানুষকে নিয়েই এমন সমস্যার সুরাহা করতে হবে। জেলার নেতাদের প্রশ্নের জবাবেই তাঁর আশ্বাস, উদ্বাস্তুদের (যার মধ্যে মতুয়ারাও আছেন) নাগরিকত্বের দাবির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করবে। জেলার নেতারা যেমন দলের সেনাপতির সঙ্গে আদানপ্রদানে খুশি, তেমনই বৈঠকে থাকার বিশেষ অনুমতি পেয়ে উচ্ছ্বসিত যুধাজিৎ সেন মজুমদারের মতো মার্কিন প্রবাসী তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। যুধাজিতের কথায়, “ম্যাডিসন স্কোয়ারে মোদীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখেছি। দেশকে সত্যিকারের উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার কাজে অংশ নেওয়াই আমার এখানে আসার কারণ।”