কল্যাণীর সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মুকুল রায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
শেষ হেমন্তের দুপুরে ফুটবল মাঠে তাঁবু পড়েছে। চেহারায় দশাসই। কল্যাণীর সেন্ট্রাল পার্কের লাগোয়া তাঁবুর চার গেটেই সর্পিল লাইন।
সার্কাস নাকি? তাঁবুর বাইরের বাহারি তোরণ অবশ্য ভুল ভাঙিয়ে দিচ্ছে। এ আসলে তৃণমূলের ত্রিস্তর রাজনৈতিক সম্মেলনের সামিয়ানা। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ এই তিন জেলার বাছাই করা প্রতিনিধিদের জন্য। ভিতরে ঢুকলে কিন্তু আবার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল!
ভিতরে ঢোকার আগে বাইরের ছবিটা আর একটু সেরে নেওয়া যাক। পানীয় জলের পাউচ হাতে গলায় কার্ডধারী প্রতিনিধিরা এগিয়ে চলেছেন অন্য একটি সামিয়ানার দিকে। সেখানে হাতে হাতে গরম ভাত, ডাল, মিক্সড সব্জি এবং ডবল ডিমের ঝোল। সৌজন্যে খাদ্যমন্ত্রী এবং উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। মন্ত্রীমশাই নিজেও আম কর্মীদের সঙ্গে ঝোল খেয়েছেন। এবং পরম তৃপ্তি পেয়েছেন। আর মাইক্রোফোনে তৃণমূলের নদিয়া জেলা কমিটিকে অনবরত ‘সংগ্রামী অভিনন্দন’ জানানো হচ্ছে বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধিদের (বাছাই করার পরেও সংখ্যাটা ১৮ হাজার বলে তৃণমূল নেতৃত্ব জানাচ্ছেন) মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করার জন্য। সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসে ভেনেজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার জন্য অভিনন্দন দেখে অনেকের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়। কিন্তু ডিমের ঝোলের জন্য সংগ্রামী অভিনন্দন? এ বাংলায় ফের ‘ঐতিহাসিক নজির’ই হবে!
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলে দিয়েছিলেন, তাঁদের দলে বিশেষ গোপনীয়তার কিছু নেই। তবু মিডিয়া যে হেতু আশেপাশে ছড়িয়ে আছে, তা-ই সাংগঠনিক বক্তব্য সেই ভাবে সাজিয়ে নিতে হবে। মানে ‘চেপে’ বলতে হবে। মুকুলের নির্দেশের অর্থ পড়ে নিতে অসুবিধা হয়নি কারও। সম্মেলন চলছিলও সেই ঢঙেই। কিন্তু এর পরেই প্রায় দুয়ার ভেঙে জ্যোতির্ময়ের মতো ঢুকে পড়লেন এক এবং অদ্বিতীয় এক জন। পায়ে পায়ে টলিউডের অধুনা ‘বিশিষ্ট’ শ্রীকান্ত মোহতাও। পৌঁছেই সটান জানিয়ে দিলেন, “আমি ৫০-৬০ মিনিট বলব।” তখন কোথায় আর কার নির্দেশ!
এ বার ভিতরে যাওয়া যাক। মঞ্চ আলো করে বসে আছেন তিন জেলা থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য, সাংসদ, বিধায়ক ও অন্য নেতারা। নেই কেবল কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল। দাদার দ্বিতীয় কীর্তির পরে তিনি থাকবেন, এমন আশাও অবশ্য কেউ করেনি। সে সময়ে মঞ্চে উঠে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন এক চিত্রগ্রাহক। তাঁকে মঞ্চের নীচের ছবি তোলার নির্দেশ দিয়ে মমতা হঠাৎ বললেন, “শুধু আমার ওপরটা দেখালে হবে না, নীচেটাও দেখাতে হবে।”
প্রথম ধাক্কাটা এল তখনই। তার পরে বললেন, “আমাদের দলের রাজ্য স্তরে কোনও গোষ্ঠী-টোষ্ঠী নেই। কী।, আছে কিছু? উঠে দাঁড়ান!” দলনেত্রীকে আশ্বস্ত করে না বিস্মিত করে, কিছু বোঝা গেল না কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়ালেন না! দলনেত্রী এমনিতেই স্বভাব-নাছোড়। তিনি আবার ওই প্রসঙ্গে ফিরে এলেন একটু পরেই। “আমার কাগজ আছে বলে লিখে দিলাম? মমতার সঙ্গে মুকুলের ঝগড়া, অভিষেকের সঙ্গে শুভ্রাংশুর ঝগড়া, পার্থদার সঙ্গে বক্সীর ঝগড়া, সব্যর (সব্যসাচী দত্ত) সঙ্গে সুজিতের ঝগড়া, ববির সঙ্গে অরূপের (বিশ্বাস) ঝগড়া, কাকলির সঙ্গে কৃষ্ণার (চক্রবর্তী) ঝগড়া!” একটু থেমে যোগ করলেন, “৩০ বছরেও হবে না! নয়তো আমাকে মেরে ফেলতে হবে!”
এঁদের মধ্যে একমাত্র তৃণমূলের অন্দরে মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর হৃদ্যতার কথা সুবিদিত। কিন্তু ঝগড়া নেই বলতে গিয়ে দলনেত্রী কী ভাবে বেছে বেছে ঠিক বাকি সেই জুটিগুলিরই নাম বললেন, যাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিরোধ আছে? কর্মীকুল যখন এই ভাবতে গিয়ে আকুল, মঞ্চ থেকে বাণী এল “জেলার কিছু পকেটে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব থাকতে পারে।” সঙ্গে তিরস্কার-সহ নির্দেশ, এ সব বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ বাহিনী হিসাবে মা-মাটি-মানুষের দল সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-কে মাটি ধরিয়ে দেবে।
কর্মীরা হাততালি দিয়ে নিজেদের অস্বস্তি সহজ করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এমন সময় আবার বিদ্যুচ্চমকের মতো শোনা গেল, অনুকূল ঠাকুর চিট ফান্ড চালাতেন! ওটা যে মুখ ফস্কে মাইতি ঠাকুর হয়েছেন, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের কর্মী মহলে তেমন বার্তা পৌঁছেছে বলে মনে হল না। তাঁরা মাথা নিচু করে অস্বস্তি সামাল দিলেন। চলতে চলতে এ বার অটো এবং ট্যাক্সিচালকদের জন্য বিমা করানোর পরামর্শ দিলেন মুখ্য বক্তা। নির্দেশ পালনের জন্য মঞ্চে খুঁজলেন মদন মিত্রকে! সিবিআই যাঁকে খুঁজছে, দলনেত্রীও তাঁকে খুঁজছেন দেখে মঞ্চের সব মুখমণ্ডল তখন বিস্ময়ে রাঙা! পরিবহণমন্ত্রী যে এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন, রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানেন না এ-ও কী হতে পারে!
এক সময় এল কল্যাণীর উন্নয়নের প্রসঙ্গ। কোনও চেয়ারম্যান আছেন? মঞ্চ থেকেই মুখ বাড়ালেন দলের এক বিধায়ক-চেয়ারম্যান। “ও তো রানাঘাটের। ওকে দিয়ে কী হবে?” জবাব শুনে বসে পড়লেন উত্তরদাতা। প্রায় বেঁধে এনে মঞ্চে এ বার হাজির করা হল কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যানকে। কাজ ভালই হয়েছে। কিন্তু ত্রিফলা আলো লাগানো হয়েছে কই? তুরন্ত মার্কশিট ধরিয়ে দিলেন দলনেত্রী। অস্ত্রোপচার সফল কিন্তু রোগী বাঁচেনি বুঝে নেমে গেলেন চেয়ারম্যান। এ বার খোঁজ হল কল্যাণীর আইটি পার্কের। পার্থবাবু তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী থাকার সময়ের ওই প্রকল্প ভালই এগোচ্ছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করলেন তৃণমূল নেত্রী। মিটারে নম্বর বাড়ছে বলেই হয়তো পার্থবাবু এ বার পকেট থেকে নোটবুক বার করে কিছু লিখে এগিয়ে দিলেন দলনেত্রীর পোডিয়ামে।
“পার্থদা একটা সাজেশন দিয়েছে। আমার আগেই ভেবে করে ফেলা হয়ে গিয়েছে। জানে না!” ঝটিতি উত্তরে ১৮ হাজার মুখের সামনে চড়চড় করে নেমে গেল নম্বর-মিটার! আর খাদ্যমন্ত্রীর জন্য থাকল ‘সংগ্রামী অভিনন্দন’। একটু অন্য ভাষায়। “বালুটা এত খাটে! এই জঙ্গলমহলে চাল পৌঁছে দিচ্ছে তো ডুয়ার্সে আটা দিচ্ছে!” শুনে খাদ্যমন্ত্রীর কায়িক পরিশ্রমের সার্টিফিকেট মনে হলে প্রতিবেদক দায়ী নন!
প্রশ্ন উঠতে পারে, ভিতরে ঢুকতে টিকিট লেগেছিল? আজ্ঞে না!