বহু চিঠিচাপাঠি জমা দেওয়া হয়েছে সরকারের বিভিন্ন দফতরে। একের পর এক বৈঠক হয়েছে। নানা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু সমস্যা মিটছে না ট্রাকমালিকদের। অভিযোগ, রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতিতেও মেটেনি ওভারলোডিংয়ের সমস্যা। কমেনি পুলিশের ‘জুলুম’। তার উপর, খারাপ রাস্তায় গাড়ির কলকব্জা ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ট্রাক মালিকেরা বলছেন, সরকার নজর না দেওয়ায় দিনের পর দিন ব্যবসা মার খাচ্ছে তাঁদের। আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবহণ শিল্প।
শিল্প এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সড়ক পথে মাল পরিবহণের জন্য ট্রাকের ভূমিকা অপরিসীম। প্রশাসন সূত্রের খবর, এ রাজ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ ট্রাক আছে। তবু নানা সমস্যায় ভুগছে এই শিল্প।
মালিকেরা জানালেন, যে কোনও ট্রাক মালিকের কাছে পাওয়া যাবে হরেক রকম ছবি ছাপানো বেশ কিছু কার্ড। কোনওটায় ছাপানো মা কালীর মূর্তি, কোনওটায় দুর্গার। ট্রাক মালিকদের দাবি, এগুলো বিভিন্ন থানার মাসিক কার্ড। হুগলি জেলার এক ট্রাক মালিকের কথায়, “বিভিন্ন জায়গায় হোটেলে, পানের দোকানে এই কার্ডগুলোর বিনিময়ে ট্রাক থেকে টাকা নেওয়া হয়। থানার যে ডাকমাস্টার থাকেন, তিনিই টাকা নেন।” এই জেলারই অন্য এক ট্রাক মালিকের দাবি, “শুধু মাসিক টাকা দেওয়াই, দিল্লি রোড, মুম্বই রোড-সহ বিভিন্ন হাইওয়েতে রাতভর পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের হাতে কিছু গুঁজে দিতেই হয়। না হলে নানা অছিলায় মিথ্যা কেস দেওয়া হয়। চালক-খালাসির উপর জুলুম করা হয়। ফলে আমাদের লাভের গুড় পিঁপড়েয় খায়।” এ বিষয়ে রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “নির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই তা দেখা হবে।”
ট্রাকে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণ (ওভারলোডিং) দীর্ঘদিনের সমস্যা। রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের দাবি, ওভারলোডিংয়ের সমস্যা দূর করতে নিয়মিত রাস্তায় তল্লাশি চালানো হয়। জরিমানা করা হয়। ট্রাক মালিকদের অবশ্য অভিযোগ, প্রশাসনই চায় না যে ওভারলোডিং বন্ধ হোক। ট্রাক মালিকদের দাবি, যে জায়গা বা সংস্থা থেকে ট্রাকে মালপত্র তোলা হয় (লোডিং পয়েন্ট), সেখানে নজরদারি করলেই সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু তা না করে রাস্তায় ট্রাক আটকে জরিমানা আদায় করা হয়। তবে জরিমানা সব ক্ষেত্রে কাগজপত্রে আদায় হয় না। ফলে রাজস্ব ক্ষতি হয় সরকারের।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরের এক ট্রাক মালিক বলেন, “প্রতিযোগিতার বাজারে একটা ট্রাক অতিরিক্ত মাল না নিলে অন্য ট্রাক নেবে। সেই কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে রাজি হয় না। কিন্তু লোডিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ওভারলোডিং বন্ধ না করে ইচ্ছে করেই রাস্তায় ট্রাক থেকে টাকা নেওয়া হয়। আইন থাকলেও যে সংস্থা মাল পাঠাচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।” ওই ট্রাক মালিকের দাবি, “সব টাকা কিন্তু সরকারের ঘরে জমা পড়ছে না। এক শ্রেণির অসাধু অফিসার এর সুযোগ নেন। আর লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয় সরকারের।” অভিযোগ, রাজ্যের সর্বত্রই ওভারলোডিং এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের নামে কার্যত জুলুম করা হচ্ছে ট্রাকচালক এবং খালাসিদের উপরে। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং দুই ২৪ পরগনায় এই সমস্যা বেশি।
ইউনাইটেড ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর হুগলি-র যুগ্ম আহ্বায়ক তথা ফেডারেশন অব ওয়েস্টবেঙ্গল ট্রাক অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সহ সম্পাদক প্রবীর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আসলে দিনের পর দিন আমরা শোষিতের দলে পড়ে যাচ্ছি। গত পাঁচ বছরে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি অন্তত ২৫ টাকা বেড়েছে। অথচ ভাড়া বাড়েনি।” তাঁর আরও অভিযোগ, “আমরা সব রকমের কর দিই। কিন্তু ক’টা জায়গায় রাস্তা ভাল আছে? জিটি রোড এত ভাঙা যে, গাড়ি চালানো দুষ্কর। দিল্লি রোডের দশাও বেহাল। উত্তরবঙ্গের রাস্তাগুলোও ভাঙাচোরা।”
ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিত্ মজুমদার বলেন, “পরিবহণ শিল্পে ট্রাকের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এই শিল্প আজ বেকায়দায় পড়েছে। পরিস্থিতির কথা জানিয়ে নানা সময়ে মুখ্যমন্ত্রী, পরিবহণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরে আমরা লিখিত ভাবে সমস্যার কথা জানিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতির কোনও বদল হচ্ছে না।”
রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের বক্তব্য, “শুধু কি এ রাজ্যেই ট্রাকে মালপত্র লোড হয়? নানা রাজ্যে হয়। সেখানে তো আমাদের পক্ষে নজরদারি করা সম্ভব নয়। বরং ট্রাক মালিকেরা নিজেরাই দেখুন যাতে নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে বেশি মাল গাড়িতে তোলা না হয়। তাতেই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হবে।”