টাকা সরাতেই শ’দুয়েক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সারদার

সারদা গোষ্ঠীর দু’শোরও বেশি সংস্থা খোলা হয়েছিল আমানতকারীদের কয়েকশো কোটি টাকা সরানোর জন্য। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকে পাঠানো রিপোর্টে সে কথাই নির্দিষ্ট করে জানিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। সারদা কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই অভিযোগ উঠেছিল, শ’য়ে-শ’য়ে নতুন সংস্থা খুলে আমানতকারীদের টাকা সরিয়ে নিয়েছিলেন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন।

Advertisement

অত্রি মিত্র

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০২:৩৯
Share:

সারদা গোষ্ঠীর দু’শোরও বেশি সংস্থা খোলা হয়েছিল আমানতকারীদের কয়েকশো কোটি টাকা সরানোর জন্য। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকে পাঠানো রিপোর্টে সে কথাই নির্দিষ্ট করে জানিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।

Advertisement

সারদা কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই অভিযোগ উঠেছিল, শ’য়ে-শ’য়ে নতুন সংস্থা খুলে আমানতকারীদের টাকা সরিয়ে নিয়েছিলেন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। অর্থ মন্ত্রককে দেওয়া ইডি-র রিপোর্টে সেই অভিযোগের সত্যতাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন। সাধারণত নিষ্ক্রিয় অথচ আমানতকারীদের টাকা সরানোর কাজে ব্যবহৃতএমন সংস্থার নির্দিষ্ট হিসেব অর্থ মন্ত্রকে পাঠিয়েছে ইডি।

ওই রিপোর্টে ইডি জানিয়েছে, সারদা গোষ্ঠীর ২২৪টি সংস্থা ছিল। কিন্তু আমানতকারীদের টাকার প্রায় ৭৫% তোলা হত চারটি সংস্থার মাধ্যমে। বাকি ২৫% অর্থ আমানতকারীদের কাছ থেকে তুলেছিল আরও ৮ সংস্থা। এ ছাড়া, আরও পাঁচটি সংস্থা সক্রিয় ছিল অন্যান্য কাজকর্মে। অর্থাৎ সারদার ১৭টি সংস্থা বাস্তবে কাজ করত বা ‘অপারেশনাল’ ছিল। তদন্তে ইডি জেনেছে, বাকি ২০৭টি সংস্থার অস্তিত্ব ছিল খাতায়-কলমে। আমানতকারীদের টাকা নিঃশব্দে সরানোর যন্ত্র ছিল ওই সংস্থাগুলিই।

Advertisement

কী ভাবে চলত এই কাজ?

ইডি তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে ওই ২০৭টি সংস্থাকে ‘ঘুমন্ত’ বা ‘ডরম্যান্ট’ আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু সংস্থাগুলি যে চালু রয়েছে, তা দেখাতে মূল চারটি সংস্থা থেকে সেগুলিতে খাতায়-কলমে নিয়মিত শেয়ার ‘ট্রান্সফার’ করা হত। সেই হিসেব পেশ করাও হত ‘রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ’-এ। অথচ বাস্তবে ওই ২০৭টি সংস্থায় প্রায় কোনও টাকাই জমা পড়ত না। ওই সব সংস্থায় জমা না দিয়ে সেগুলি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। ওই বিপুল পরিমাণ টাকা আসতে কোথায় গেল, তাতে কারা লাভবান হল, এ বার সেটাই খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ইডি। বস্তুত, এখানেই কিন্তু চলে আসছে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ প্রসঙ্গটি।

ইডি সূত্রের খবর, তাদের জেরায় সুদীপ্ত সেনও জানান, সারদার ওই দু’শোটিরও বেশি সংস্থায় খাতায়-কলমে হলেও বাস্তবে কোথাওই শেয়ার লেনদেন হয়নি। একমাত্র যে সব সংস্থাকে সারদা কিনে নিয়েছিল, বাস্তবে সেই সব সংস্থারই শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এই ধরনের সংস্থার উদাহরণ হল: গ্লোবাল অটোমোবাইল লিমিটেড, শেরউড হোটেল অ্যান্ড রিসর্টস প্রাইভেট লিমিটেড।

ইডি-র বক্তব্য, জেরায় সুদীপ্ত আরও জানান, মূলত ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমানতকারীদের অর্থের ৭৫% টাকা তোলা হয় সারদার চারটি সংস্থার মাধ্যমে। সেগুলি হল: সারদা রিয়েলটি, সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস, সারদা গার্ডেন, রিসর্টস অ্যান্ড হোটেলস প্রাইভেট লিমিটেড এবং সারদা হাউজিং। বাকি ২৫% অর্থ তুলেছিল সারদার অন্য আটটি সংস্থা। সেগুলি হল: সারদা কনস্ট্রাকশন, সারদা ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, বেঙ্গল মিডিয়া, সারদা এক্সপোর্টস, ব্রডকাস্ট ওয়ার্ল্ডওয়াইড, সারদা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, সারদা অ্যাগ্রো ডেভেলপমেন্ট এবং সারদা মেডিটেক।

তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এর মধ্যে বেঙ্গল মিডিয়া, সারদা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স-এর মতো সংস্থাগুলিই সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সারদা মেডিটেক আবার যুক্ত হয়েছিল রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ ভাবে মাওবাদী প্রভাবিত জঙ্গলমহল তল্লাটে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা চালু করার প্রকল্পে। ২০১১-র জুলাইয়ে মহাকরণের সামনে থেকে জঙ্গমহলের ওই অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইডি-র জেরায় সুদীপ্ত সেন ও সারদা গোষ্ঠীর অন্যতম ডিরেক্টর দেবযানী মুখোপাধ্যায় জানান, মুখ্যমন্ত্রী যাতে ওই প্রকল্পে সিলমোহর দেন ও প্রকল্পের উদ্বোধন করেন, তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হন কুণাল ঘোষ-সহ শাসক দলের বেশ কিছু শীর্ষ নেতা। ওই অ্যাম্বুল্যান্স প্রকল্পের উদ্বোধন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জঙ্গলমহলে তাঁর প্রথম সফর শুরু করেছিলেন মমতা।

ইডির জেরায় দেবযানী মুখোপাধ্যায় জানান, ‘ঘুমন্ত’ সংস্থাগুলি তৈরির জন্য রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ বা আরওসি-তে ড্রাফ্ট জমা দেওয়া হয়েছিল সারদা রিয়েলটি ইন্ডিয়া লিমিটেডের অ্যাকাউন্ট থেকে। ইডি সূত্রের খবর, দেবযানীর দাবি, সারদা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থায় তাঁর নামে যে সব শেয়ার রয়েছে, সে সব কেনার জন্য তিনি একটি পয়সাও দেননি। শেয়ারগুলি খাতায়-কলমে বণ্টন করা হলেও বাস্তবে সেগুলি কাউকে বরাদ্দ করা হয়নি। সারদা গোষ্ঠীর আর এক কর্ত্রী দেবিকা দাশগুপ্তও জানিয়েছেন, তিনিও কোনও দিন তাঁর নামে কোনও শেয়ার বণ্টনের কথা শোনেননি এবং শেয়ারের ভিত্তিতে কোনও দিন এক পয়সাও ‘ডিভিডেন্ট’-ও পাননি। অথচ দেবিকা দেবীর নামেও শেয়ার বণ্টন করা হয়েছিল বলে খাতায়-কলমে দেখানো হয়েছে।

ইডি তদন্তে জেনেছে, ২০০৮ থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আমানতকারীদের থেকে সারদা গোষ্ঠী তুলেছিল প্রায় ২৪৬০ কোটি টাকা। ওই ২৪৬০ কোটি টাকার মধ্যে ৪৭৭ কোটি টাকা প্রতিশ্রুতি মতো আমানতকারীদের ফেরত দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। ২০১৩-র ১৬ এপ্রিল ওই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে সুদীপ্ত সেনের গা-ঢাকা দেওয়ার দিন পর্যন্ত আমানতকারীদের ১৯৮৩ কোটি টাকা ছিল সারদা গোষ্ঠীর হাতে। এই হিসেব মতো সুদ বাদ দিয়ে এখনও ১৯৮৩ কোটি টাকা আমানতকারীদের মেটাতে হবে সারদা গোষ্ঠীকে। সেই কারণেই ইডি বলেছে, সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ মোট ১৯৮৩ কোটি টাকা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement