সেই জয়রামনের রাস্তাতেই ফিরল সরকার। অথচ দশ মাস আগে সরতে হয়েছিল তাঁকেই।
তারিখটা ৩০ নভেম্বর, ২০১৩। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদে (এসজেডিএ) বহু কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় শিলিগুড়ির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কে জয়রামন সে দিন গ্রেফতার করেছিলেন মালদহের তৎকালীন জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমারকে। সেই ‘অপরাধে’ রাজ্য সরকার জয়রামনকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেয়।
এত দিনে কিন্তু সেই গোদালার বিরুদ্ধেই চার্জশিট দিতে চলেছে সিআইডি। গোয়েন্দা দফতর স্বীকার করছে, তদন্তে জয়রামনের রাস্তা ধরে এগিয়েই সাফল্য পেয়েছেন তাদের অফিসারেরা। শুক্রবার নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “কেন্দ্রের অনুমতি পেলে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন তো বটেই, ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারাতেও গোদালার বিরুদ্ধে মামলা করবে রাজ্য সরকার।”
দুর্নীতি মামলায় ইতিমধ্যেই এসজেডিএ-এর একাধিক ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে রাজ্য। তবে গোদালা কিরণকুমার যে হেতু আইএএস অফিসার, সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে হলে কেন্দ্রের অনুমোদন দরকার। সিআইডি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সেই অনুমোদন চেয়ে পাঠিয়েছে। তা হলে কি রাজ্য সরকার এখন মানবে যে, জয়রামনই ঠিক কাজ করেছিলেন? তাঁকে সরানো ভুল হয়েছিল? উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এর উত্তরে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কোনও দিনই দুর্নীতির সঙ্গে আপস করেননি। বিচারাধীন বিষয়ে এর বেশি কিছু বলব না।” জয়রামন নিজে কি মনে করছেন তাঁর নৈতিক জয় হলো? শিলিগুড়ির প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার এ নিয়ে কথা বলতে চাননি।
মালদহের জেলাশাসক পদে আসার আগে এসজেডিএ-র সিইও ছিলেন গোদালা। ওই পদে থেকেই তিনি প্রায় ৭০ কোটি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বার উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে এসজেডিএ দুর্নীতি সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগ যায় পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। এর পরেই ফিরহাদ এবং গৌতম কিছু ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করান। তদন্তে বিপুল টাকার দুর্নীতির সন্ধান মেলে। যেমন দেখা যায়, বেশ কিছু প্রকল্প না হলেও তার টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও হয়তো এক হাজার বর্গফুট মাটি কাটার কথা ছিল। কিন্তু পরে দু’টো শূন্য অতিরিক্ত বসিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ বর্গফুটের। প্রাথমিক ওই তদন্ত রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দেন ফিরহাদ, গৌতমরা। তার ভিত্তিতেই প্রথমে কিরণকুমার এবং পরে এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যকে সরানো হয়।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে বদলি হয়ে মালদহের জেলাশাসক পদে চলে যান গোদালা। এসজেডিএ-র নতুন সিইও হন শরদ দ্বিবেদী। তিনিই রাজ্য প্রশাসনের নির্দেশে সরকারি তদন্ত শুরু করেন। প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ মেলায় ২০১৩ সালের মে মাসে ৮টি পৃথক দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়। ৩০ নভেম্বর গোদালাকে গ্রেফতার করেন শিলিগুড়ির তখনকার কমিশনার জয়রামন। কিন্তু রাজ্য সরকার ওই গ্রেফতার অনুমোদন করেনি। ফলে পরের দিনই জামিন পেয়ে যান গোদালা। তাঁকে কম্পালসারি ওয়েটিং-এ পাঠানো হয়। জয়রামনকেও কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে যেতে হয়। বর্তমানে তিনি রাজ্য পুলিশের আইজি (মর্ডানাইজেশন)-এর পদে রয়েছেন।
নবান্নের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, রাজ্য প্রশাসনকে না জানিয়ে গোদালাকে গ্রেফতার করে জয়রামন বিধিভঙ্গ করেছেন। মুখ্যসচিব সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছিলেন, যখন অভিযুক্তের পালিয়ে যাওয়ার, সাক্ষীদের প্রভাবিত করার বা সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের আশঙ্কা থাকে, তখনই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু গোদালা কিরণকুমারের ক্ষেত্রে এর কোনওটাই প্রযোজ্য ছিল না। সাধারণ ভাবে কোনও পদস্থ আধিকারিকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার আগে রাজ্য সরকারের অনুমতি নেওয়া বা তাকে জানানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কোনওটাই করা হয়নি।
অন্য দিকে রাজ্যের একাধিক পুলিশ-কর্তার দাবি ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্মসচিব কিংবা তার চেয়ে উঁচু পদের অফিসারকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। সেই নিয়ম রাজ্যের ক্ষেত্রে খাটে না। ‘কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর’-এর সংশোধিত ৪১ নম্বর ধারা উল্লেখ করে (যে ধারায় গ্রেফতার করা হয়) তাঁরা বলেছিলেন, তদন্তকারী সংস্থা যদি মনে করে অভিযুক্ত কোনও ভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করছেন এবং সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ পুলিশের হাতে আছে, তা হলে তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য রাজ্য সরকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁদের দাবি ছিল, কিরণকুমারকে গ্রেফতার করে জয়রামন আইনগত দিক থেকে কোনও অন্যায় করেননি। বরং গোদালার জামিনের বিরোধিতা না-করে সরকার দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অফিসারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁরা। সেই চাপের মুখেই রাজ্য প্রশাসন গোদালার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য দুর্নীতি দমন শাখাকে দায়িত্ব দেয়। পরে তদন্তভার যায় সিআইডি-র হাতে।
এখন সিআইডি সূত্রে মানা হচ্ছে, গোদালার বিরুদ্ধে আটঘাট বেঁধেই তদন্তে নেমেছিলেন জয়রামন। অন্ধ্রপ্রদেশের খাম্মামে গোদালার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তিনি গোদালার সম্পত্তি সংক্রান্ত নথি জোগাড় করে এনেছিলেন। এমনকী, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সিইও হওয়ার পরে গোদালা খাম্মামে যে সব জমি কিনেছেন, তারও দলিল জোগাড় করেছিলেন তিনি। জয়রামনের পাওয়া ওই তথ্যের ভিত্তিতেই সম্প্রতি ফের খাম্মামে গোদালার বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালায় সিআইডি। সিআইডি-র এক অফিসার জানিয়েছেন, খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন কিরণকুমার। এখনও তাঁর বাবা-মা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন। সিআইডি অফিসারদের কাছে তাঁরা দুঃখ করেছেন, বড় অফিসার হয়ে যাওয়ার পরে ছেলে এখন আর তাঁদের খোঁজ রাখেন না।
সিআইডি অফিসারেরা এও জেনেছেন, কিরণকুমার এবং তাঁর স্ত্রী দু’জনেই বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশের একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সরকারি অফিসার হিসেবে এই কাজ আইনবিরুদ্ধ। তাঁর স্ত্রী গত লোকসভা ভোটে ওই দলের প্রার্থীও হয়েছেন। এ ছাড়া, হায়দরাবাদ-সহ অন্ধ্রপ্রদেশের বেশ কিছু জায়গায় কিরণকুমারের কয়েক জন নিকটাত্মীয়ের নামে বিপুল সম্পত্তির হদিস পেয়েছে সিআইডি। যা গত দু’তিন বছরে কেনা হয়েছে। এর পরেই রাজ্য সরকারের কাছে গোদালার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে রিপোর্ট পাঠিয়েছে সিআইডি।
বিরোধীরা যদিও অভিযোগ করছেন, সরকার এখন গোদালাকে চার্জশিট দিয়ে দুর্নীতির আসল ‘চাঁই’দের আড়াল করতে চাইছে। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য দীর্ঘ সময় এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। অশোকবাবু বলেন, “এসজেডিএ-এর একটা বোর্ড রয়েছে। সেই বোর্ডের চেয়ারম্যান না-চাইলে এক টাকাও কেউ খরচ করতে পারে না। কাজেই এক জন সরকারি অফিসার একা দুর্নীতি করেছেন, চেয়ারম্যান-বোর্ড সদস্যদের কেউ কিছু জানে না, এটা অবিশ্বাস্য।”
সম্প্রতি হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে দ্রুত এসজেডিএ তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দেয়। এর পরেই রাজ্য তড়িঘড়ি গোদালার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে উদ্যোগী হয়েছে বলে বিরোধী দলগুলির দাবি। অশোকবাবুর অভিযোগ, “গোদালাকে গ্রেফতারের পরে আরও কয়েক জনকে ধরার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন জয়রামন। সেটা জানতে পেরেই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়।” প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর দাবি, শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদের তদানীন্তন চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যকে আড়াল করতেই কিরণকুমারকে ‘বলির পাঁঠা’ করছে সরকার। তবে এসজেডিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ফের বলেন, “এটা বিচারাধীন বিষয়। কোনও মন্তব্য করব না।”