জিএসটি নিয়ে ফের বার্তা দিলেন জেটলি

কেন্দ্রের আনা পণ্য-পরিষেবা অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা নয়, বরং তাকে সমর্থন করলেই আখেরে রাজ্যের ভাল হবে। বুধবার ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর মঞ্চে দাঁড়িয়ে আরও এক বার বলে গেলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেই সঙ্গে দিয়ে গেলেন কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের বার্তা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৬
Share:

কেন্দ্রের আনা পণ্য-পরিষেবা অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা নয়, বরং তাকে সমর্থন করলেই আখেরে রাজ্যের ভাল হবে। বুধবার ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর মঞ্চে দাঁড়িয়ে আরও এক বার বলে গেলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেই সঙ্গে দিয়ে গেলেন কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের বার্তা।

Advertisement

দু’দিন আগেই আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জেটলি বলেছিলেন, সংসদে বিক্ষোভ দেখিয়ে বাংলায় উন্নয়নের চিঁড়ে ভিজবে না। রাজ্যের উচিত কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় করে চলা। বুধবার সেই একই বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি আশ্বাস দিলেন, রাজনৈতিক মতবিরোধ সরিয়ে রেখে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে কেন্দ্র পূর্ণ সহযোগিতা করবে। জেটলির কথায়, “রাজ্যে উপযুক্ত বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করলে বিনিয়োগ আসবেই। এ রাজ্যে যে বিনিয়োগ হবে, তার প্রতিটি টাকা, প্রতিটি ডলারের পিছনে কেন্দ্র থাকবে।”

সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন, “রাজনীতি উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।” জেটলিকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে তুলে আসার পরে সাংবাদিকদেরও তিনি বলেন, “রাজনৈতিক মতভেদ রাজ্যসভায় থাকতে পারে। কিন্তু শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নয়। রাজনৈতিক মতভেদ উন্নয়নকে ধ্বংস করতে পারবে না।”

Advertisement

কিন্তু বাস্তবে কি তার প্রতিফলন হবে? শিল্প মহলের একটা বড় অংশই কিন্তু বলছে, মুখ্যমন্ত্রী মুখে সহযোগিতার কথা বললেও কাজে তা করে দেখাচ্ছেন না। এমনিতেই লোকসভা ভোটের প্রচার পর্বে মোদীকে বেনজির আক্রমণ করেন তিনি। মোদী ক্ষমতায় আসার পরে বরফ গলেনি। দেশের আর সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নয়া প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমাফিক শুভেচ্ছা জানালেও মমতা সেই পথে হাঁটেননি। বিজেপি সরকার গড়ার প্রায় সাড়ে ৫ মাস পরে এই মাত্র সে দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। অনেকের মতে, সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের বিপুল চাপ না-থাকলে সেই সাক্ষাৎও হতো কিনা সন্দেহ।

তার উপর সংসদের সদ্য শেষ হওয়া অধিবেশনে তৃণমূল যে ভূমিকা নিয়েছে, তাতে কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে তাদের দূরত্ব আরও বেড়েছে। তৃণমূল সাংসদরা যে ভাবে বিমা, জমি, কয়লা খনি বণ্টন ও পণ্য-পরিষেবা (জিএসটি) বিলের বিরোধিতা করেছেন, তাকে ‘ধ্বংসাত্মক রাজনীতি’ আখ্যা দেন জেটলি। তৃণমূল সাংসদদের বিরোধিতায় সংসদ চলতে পারেনি। তাই অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন বলবৎ করতে হয়েছে সরকারকে।

এ দিন সৌজন্যের খাতিরে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চ থেকে তৃণমূলের সেই বিরোধিতা নিয়ে কড়া সুরে কিছু বলেননি জেটলি। বরং সংযত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, জিএসটি এবং কয়লা নিলাম চালু হলে আখেরে রাজ্যই লাভবান হবে। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের এক টাকা ক্ষতি হলেও কেন্দ্র তা পূরণ করে দেবে।

পরে হাওড়ায় দলীয় অনুষ্ঠানে অবশ্য আর সৌজন্য দেখানোর দায় ছিল না কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর। সেখানে তিনি বলেন, “তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে পণ্য-পরিষেবা করকে সমর্থনের কথা লেখা আছে। তা হলে সমর্থনই করুন। অন্তত এর সঙ্গে তো সারদার কোনও যোগ নেই। কয়লা নিলাম থেকে সব থেকে লাভবান হবে পশ্চিমবঙ্গ-সহ চারটি রাজ্য। পণ্য-পরিষেবা কর থেকেও সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে তারা। ফলে এখানকার সাংসদদের তো তা সমর্থন করার কথা। যদি না শুধু রাজনৈতিক কারণেই বিরোধিতা করা হয়।”

শিল্প মহলেরও বক্তব্য, জিএসটি চালু হলে আখেরে রাজ্যের লাভ হবে। ইয়েস ব্যাঙ্কের শীর্ষ কর্তা রানা কপূরের কথায়, “পণ্য পরিষেবা কর চালুর জন্য রাজ্য-কেন্দ্র সহযোগিতা জরুরি। এবং এই সহযোগিতা থাকলে, আমি বিশ্বাস করি, রাজ্যের উৎপাদন শিল্পে স্বাভাবিক ভাবেই গতি আসবে।”

এ দিনের অনুষ্ঠানে অবশ্য সংখ্যাতত্ত্ব তুলে ধরে উৎপাদন শিল্পে রাজ্য সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় এগিয়ে আছে বলেই দাবি করেছেন অমিত মিত্র। এবং তাঁর পরে বলতে উঠে জেটলি বিনম্র ভাবে তাঁকে মনে করিয়ে দেন, “বাস্তব থেকে চোখ ফেরানোটা অনুচিত। এ রাজ্যের বৃদ্ধিতে উৎপাদন শিল্পের অবদান এখনও খুবই কম। উৎপাদন শিল্পই কর্মসংস্থান তৈরি করবে। কৃষিক্ষেত্রে যাঁরা কর্মহীন তাঁরা এখানে কাজের সুযোগ পাবেন। এই পরিস্থিতি তৈরি করাটাই চ্যালেঞ্জ।” পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জটা আরও বড় এই কারণে যে, বড় উৎপাদন শিল্প ক্রমশ এ রাজ্য থেকে বিদায় নিয়েছে। জেটলি এ দিন তাদের ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু শিল্প মহলের বক্তব্য, মমতা সরকারের জমি নীতি বড় শিল্পের পথে মস্ত বড় প্রতিবন্ধক। এবং সেই বাধা কাটানোর কোনও ইঙ্গিত এ দিনও মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের অর্থমন্ত্রী দেননি।

কেন্দ্রের জমি বিল বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের সংঘাতের একটা বড় ক্ষেত্র। আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেটলি বলেন, কেন্দ্রের আনা জমি অর্ডিন্যান্স সমর্থন করলে আখেরে রাজ্যেরই লাভ। কেন না, জমি দিতে না-পারলে শিল্পপতিরা আসবেন না। সম্মেলনের মঞ্চে তিনি কেন্দ্র-রাজ্য সুসম্পর্কের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, প্রতিটি রাজ্যের উন্নতি হলে তবেই দেশের উন্নতি হবে। আর রাজনীতির সঙ্গে উন্নয়নের যে বিরোধিতা নেই, তা-ও রাজনৈতিক অঙ্ক কষেই বলেছেন জেটলি। তিনি জানান, তাঁরা যেমন ভোটে জিতে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছেন, মমতা একই ভাবে রাজ্যে ক্ষমতা এসেছেন। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করতে কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’পক্ষই দায়বদ্ধ। আর তাই রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও উন্নয়নের প্রশ্নে রাজ্যকে পূর্ণ সহায়তা দেবে কেন্দ্র।

শিল্প সম্মেলনের দ্বিতীয় ভাগে আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীও স্পষ্ট বললেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করছি, আমরা রাজ্যকে পূর্ণ সাহায্য করব। এবং ভাই হিসেবে আপনাকে সমস্যার সমাধানে সাহায্য করব।” রাজ্যের পাশে থাকার বার্তা দিতে এ দিনই তিনি রাজ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর, হলদিয়া বন্দরের ডক নির্মাণ, কলকাতা-শিলিগুড়ি সড়ক পথ ও হলদিয়া-বারাণসী জলপথে পরিবহণের প্রকল্পের সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার কথাও জানান। সব মিলিয়ে যেখানে কেন্দ্রের লগ্নি হবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও সেলের সম্প্রসারণ খাতে আসার কথা ৪০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ দিন ৯৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আসার যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, তার অধিকাংশই আসবে কেন্দ্রের হাত ধরে। (এবং বেশির ভাগ প্রকল্পই পুরনো, জানাচ্ছেন নবান্ন সূত্র।)

মমতা কিন্তু থেকে গিয়েছেন সেই কেন্দ্র-বিরোধী চর্বিতচর্বণেই। সম্মেলন মঞ্চ থেকে রাজ্যের ঘাড়ে থাকা ঋণের বোঝার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, সুদ বাবদ প্রতি বছর ২৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিতে হয় কেন্দ্রকে। ইউপিএ মমতাকে বারবার ফেরালেও বিজেপি ইতিমধ্যেই সেই ঋণ পুনর্গঠনের আশ্বাস দিয়েছে। তার পরেও সেই প্রসঙ্গ তোলাটা রাজনীতিতে আটকে থাকা বলেই মত শিল্প মহলের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement