ঘাম ঝরিয়েই গোল করতে চান তারকারা

মনে হচ্ছিল, কোনও সিনেমার শটের প্রস্তুতি দেখছি। রোড-শোয়ে মাইক হাতে তাঁর হয়ে কী বলে ভোট চাইতে হবে, প্রার্থী তা পাখি-পড়া পড়াচ্ছেন দলীয় কর্মীকে। ইসিএল-এর ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের নেতা তাপস ঘোষ বার কয়েক বলার চেষ্টা করে খেই হারিয়ে ফেললেন। প্রার্থীর চোখেমুখে বিরক্তি। “উঁহু, কেন পাকামি করেন মশাই! আমি বলছি, স্ক্রিপ্টের মতো সব লিখে নিন আগে।” লেখা হল। ডিক্টেশন দিয়ে পুরোটা আর একবার শুনে তবে আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী সন্তুষ্ট: “মোক্ষম হয়েছে! শুধু লাস্টে একটা ‘মোদী লাও দেশ বাঁচাও’ জুড়ে দিন।”

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৪ ০৩:১৯
Share:

মনে হচ্ছিল, কোনও সিনেমার শটের প্রস্তুতি দেখছি। রোড-শোয়ে মাইক হাতে তাঁর হয়ে কী বলে ভোট চাইতে হবে, প্রার্থী তা পাখি-পড়া পড়াচ্ছেন দলীয় কর্মীকে।

Advertisement

ইসিএল-এর ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের নেতা তাপস ঘোষ বার কয়েক বলার চেষ্টা করে খেই হারিয়ে ফেললেন। প্রার্থীর চোখেমুখে বিরক্তি। “উঁহু, কেন পাকামি করেন মশাই! আমি বলছি, স্ক্রিপ্টের মতো সব লিখে নিন আগে।” লেখা হল। ডিক্টেশন দিয়ে পুরোটা আর একবার শুনে তবে আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী সন্তুষ্ট: “মোক্ষম হয়েছে! শুধু লাস্টে একটা ‘মোদী লাও দেশ বাঁচাও’ জুড়ে দিন।”

রাজনীতির ময়দানে নতুন এসে নিজেকে দ্রুত তৈরি করে নিয়েছেন তিনি। বলিউডের তারকা-গায়ক বাবুল সুপ্রিয়। কলেজে অবধি এসএফআই, ছাত্র পরিষদের ছায়া মাড়াননি। লোকে তাঁকে দেখে ‘বম্বে কাঁপিয়ে, ভারত নাচিয়ে’টা হোক বলে আবদার করছে, এটা ঘটনা। তবে স্রেফ ‘ফ্যান’দের ভরসায় দিল্লি-যাত্রার মখমলি গালচে যে তাঁর জন্য পাতা নেই, এটাও বিলক্ষণ বুঝেছেন বাবুল। একযোগে মগজাস্ত্রে শান ও ঘাম ঝরানোর কাজ দু’টোই তাই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ভোটের দিন শাসক দলের সংগঠনের মোকাবিলায় নিজেদের ঘুঁটি সাজানোর কাজটাও তাঁকেই করতে হচ্ছে।

Advertisement

শাসক দলের তুরুপের তাস আবার দীর্ঘদেহী শ্যামলাবরণ এক দোহারা তরুণ। তাঁর সঙ্গেও রাজনীতির র-এর যোগ ছিল না। কিন্তু নতুন ভূমিকার চ্যালেঞ্জটা পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের তাবড় নেতা-প্রার্থীদের সভায় এখন নিয়ম করে হাজির করা হচ্ছে তাঁকে। ঘাটাল কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী ওরফে দেব ঘন ঘন ম্যারাথন রোড-শো করছেন। চড়া রোদে ছাতাবিহীন খোলা ম্যাটাডরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছেন তিন-চার ঘণ্টা। মোরামের রাস্তায় পাক খেতে খেতে ধুলিধূসরিত হয়ে দফায় দফায় পেরিয়ে যাচ্ছেন ৬০-৭০ কিলোমিটার। দেবসুলভ সরল হাসিটা তবু ম্লান হতে দিচ্ছেন না।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীরা দেবকে বরফঠাসা ডাবের জল, ফলের রসের বোতল এগিয়ে দেন। তাঁর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আগলে রাখেন। কিন্তু জনতার ভালবাসার অত্যাচার কে ঠেকাবে! পিংলার চকবাজারে রোড-শো শেষ করে বলছিলেন, “জানেন, নখের আঁচড়ে আমার হাত দু’টো ছেয়ে আছে। এই ভালবাসা থেকেই তো এনার্জি পাই।”

কোলিয়ারির বিখ্যাত ধুলোয় বাবুলও দিব্যি স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছেন। লোকের বাড়ি, ধর্মস্থানে ঢুকতে হবে বলে স্নিকার ছেড়ে চামড়ার চটি ধরেছেন। পাণ্ডবেশ্বরের কেন্দ্রা গ্রামে ছন্নছাড়া গিজগিজে ভিড়ের ব্যূহ ঠেলে ঘামে-ভেজা গ্রাম্য চেহারাগুলোকে জড়িয়ে ধরছিলেন তিনি। ক্ষয়াটে ছোকরা, বুড়ি ঠাকুমা বা বিহ্বল বধূ কারও সঙ্গে সহজ আলাপে খামতি নেই। কেন এত খাটছেন? “আরে দলের কর্মীদের তো আমাকেই চাঙ্গা করতে হবে। অলিম্পিকের মতো অংশগ্রহণই বড় কথা ভেবে তো আমি লড়তে আসিনি।”

দেবের চ্যালেঞ্জটা আবার ভোট জিতেই শেষ নয়। প্রচার-পর্ব চুকলে রাত পোহাতেই ফের শু্যটিং ফ্লোরে ফিরতে হবে। দেব হেসে ফেলেন, “দেখছেন, কী কালো হয়েছি! শু্যটিংয়ে মেক-আপই ভরসা। এক মাস লাগবে চামড়ার ট্যান তুলতে।” তবু দল তথা নেত্রীর প্রতি দায়বদ্ধতায় ফাঁক রাখতে চান না নায়ক। বিড়বিড় করেন, “চাঁদের পাহাড়ের শু্যটিং করতেও তো কম কষ্ট হয়নি! রাজনীতি শুধু ভোটে জেতা নয়। আমায় অনেক দূর হাঁটতে হবে।”

ঢাউস কাট-আউট, গানবাজনা, জগঝম্প দক্ষিণ ভারতে ভোট প্রচারের অঙ্গ বলে জানে সবাই। নাচ-গান-সংলাপের ফুলঝুরি ছুটিয়ে বীরভূমে জয় বন্দ্যোপাধ্যায় যা করেছেন, তাতে অনেকে তামিলনাডুর নাটুকে প্রচারেরই মোটা দাগের সংস্করণ দেখেছেন। জনৈক কণ্ঠী গায়ক জয়ের আড়াই দশক আগের হিট ছবির গান গেয়েছেন। আর সেই ছবির দৃশ্যের আদলে দর্শকদের মধ্যে থেকেই ‘নায়িকা’ খুঁজে নিয়ে জয় সে-গানে লিপ দিয়েছেন। রামপুরহাট, মুরারইয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে এমন প্রচার তুমুল সাড়া ফেলেছে।

তারকাদের ভোটযুদ্ধের ট্র্যাডিশন ঘাঁটলে এমন জঙ্গি প্রচার কিন্তু খুব সুলভ নয়। তামিলনাডুর এমজি রামচন্দ্রন, অন্ধ্রের এনটি রামারাও থেকে আজকের জয়ললিতারাও জনতার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখেন। উত্তর ভারতে হেভিওয়েট প্রার্থীর বিরুদ্ধে অমিতাভ বচ্চন বিপুল ভোটে জিতলেও এই ধারার নড়চড় হয়নি। এ যুগের ভোটের লড়াই কি তবে তারকাদেরও পাল্টে দিচ্ছে? কর্নাটকের মান্ড্য কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী কন্নড় ছবির নায়িকা রামিয়া (বয়সে দেবের থেকেও একটু ছোট) প্রচারের ফাঁকে ভোটারদের সঙ্গে ক্রিকেটও খেলেছেন।

বয়সে প্রবীণ হলেও পরিশ্রমে পাল্লা দিচ্ছেন পিসি সরকার (জুনিয়র)-ও। চোখেমুখের কালো পরত সানস্ক্রিনেও চাপা পড়ছে না। সাত সকালে প্রচার শুরু করে খোলা ম্যাটাডরে ঘোরার সময়ে জাদুকরের চোখের কাজল গাল বেয়ে নামছে। ব্যক্তিগত সহকারী টিস্যু এগিয়ে দিলেন। পিসি সরকার কথা যৎসামান্য বলছেন। কারণ লোকে নাকি তা ভাঁওতা প্রতিশ্রুতি ভাবে। তবে উদ্বেল বাচ্চা-বুড়োর ‘গিলি গিলি গে’-র জবাবে ‘ছু মন্তর ছু’ বলতেই হচ্ছে। ‘দিল্লিতে মোদী সরকার, বারাসতে পিসি সরকার’ লেখা সচিত্র কার্ড ছাপিয়ে জনে জনে নিজেই বিলি করছেন তিনি।

শ্রীরামপুরে বাপ্পি লাহিড়ী প্রধানত নিজের গান বিলিয়েই ভোটটা লড়ে ফেলেছেন। রথে ফিট করা মিউজিক সিস্টেমই ছিল প্রচারের মূল হাতিয়ার। বাপ্পিদার চামড়া কিঞ্চিৎ পুড়লেও স্নিকারে ধুলো তেমন লাগেনি। জিপ-রথের মাথায় ঢাউস লাল-নীল-হলুদ ছাতার নীচে প্রার্থী প্রধানত বসেই থাকতেন। বাছা-বাছা মোড়ে ইশারামাফিক দুই ষণ্ডা নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে দু’দিক থেকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতেন আর বাপ্পি গানে মাত করতেন।

সন্ধ্যা রায়ের আবেগমথিত বক্তৃতাও দেদার হাততালি টেনেছে। তবে বাবা তারকনাথের সুধার মতো কৃচ্ছ্রসাধন যে তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়, প্রাক্তন নায়িকা তা স্থানীয় নেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যাই তাই সন্ধ্যার প্রচারের প্রকৃষ্ট সময়। তবে দু’ঘণ্টা ধরে মেদিনীপুর শহর পরিক্রমার সময়ে এই ৭৪ বছরে চড়া হ্যালোজেনের সামনে জিপের সিটে জোড় হাতে দাঁড়াতে হয়েছে। যেতে যেতে অস্বস্তি কাটাতে বারবার এক পা তুলে শরীরের ভারসাম্য বদলানোর চেষ্টা করে চলেছেন।

তবে চেষ্টা করলেও তারকাসুলভ রাশভারি মেজাজটা ঝেড়ে ফেলা সম্ভব হয় না সবার। পটনায় শত্রুঘ্ন সিনহা যেমন এ বারও পাঁচতারা হোটেলের স্যুইটে বেলা বারোটায় রাজকীয় ঢঙে বেলের সরবতে চুমুক দিয়ে দিন শুরু করছেন। মুনমুন সেন হাসতে হাসতে এই ‘স্টারি ট্যানট্রাম’-এর ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। “হ্যাঁ, এটা ঠিকই নিজেকে সব সময়ে সবার কাছে, প্রেসের কাছে অ্যাভলেবেল (সহজলভ্য) করাটা ধাতে ছিল না। সেটা শিখতে হচ্ছে।”

গোড়ায় গাড়িতে লম্বা সফরের ধাক্কায় জ্বরজারি, ব্যথা-বেদনায় কাবু হয়েছিলেন। পরের দিকে কিন্তু রোদে টকটকে হয়ে হাসিমুখে রোড-শো করেছেন। জনতার গা ঘেঁষে হেঁটেই মঞ্চে উঠেছেন। তবে নির্ধারিত প্রচার বাতিল হলে মেজাজ চড়েছে। ম্যাডামের এই ‘সিরিয়াসনেসে’ তাঁর ভোটযুদ্ধের অন্যতম ‘মাস্টারমশাই’ বাঁকুড়ার সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বেজায় খুশি। মুনমুনের কথায়, “দেরি হলে রাগ ধরেছে ঠিকই! তবে শু্যটিং বা যাত্রাতেও এমন আনসার্টেনটি (অনিশ্চয়তা) নিয়েই তো এত দিন ঘর করেছি।”

পর্দা-মঞ্চ-স্টুডিও তারকারা কি তবে রাজনীতিরও তারকা হয়েই ছাড়বেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement