আদালতের পথে ধৃত মালখান সিংহ। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।
ঠিক এক মাস আগের কথা। বামনগোলার কাংসা গ্রামের প্রৌঢ়া সিন্ধু মণ্ডল তাঁর ফেরার বড় ছেলে মাধবের জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলছিলেন, “আমরা তো পুলিশকে বলছি, তোমরা যে ভাবে পারো, ওকে ধরো। তা হলে আমরা শান্তি পাই।”
এই কথা বলার পরে মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মাধব মণ্ডল ওরফে কেএলও-র অন্যতম শীর্ষ নেতা মালখান সিংহকে অবশেষে ধরতে পেরেছে পুলিশ। গত বছর মার্চ মাসে তৈরি হওয়া কেএলও-র নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে মালখান সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পেয়েছিল। চলতি বছর ৩০ মার্চ প্রায় হাতে এসেও পুলিশের একাংশের ভুলে ফস্কে যায় মালখান। তবে, এ বার আর কোনও ভুল করেনি পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার গভীর রাতে মালখান তার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে, মালদহের বামনগোলা থানার সিমলা গ্রামে গম্ভীরা গান শুনতে যায়। মালদহ জেলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত এই গম্ভীরা গান। আর আগে থাকতে খবর পেয়ে সেই আসরে হানা দেয় সাদা পোশাকের পুলিশের একটি দল। নিঃশব্দে মালখানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তারা। এমন ভাবে যে, টের পাওয়ার পর মালখান গম্ভীরার আসর ছেড়ে উঠে যে দিকেই পালাতে গিয়েছে, সে দিকেই পুলিশ তার পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। ওই জঙ্গি নেতা পালানোর পথ না পেলেও তার এক সঙ্গী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে।
গত ২৯ জানুয়ারি ধরা পড়া কেএলও-র সহকারী সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় ওরফে ইকবাল সিদ্দিকি জেরায় পুলিশকে জানিয়েছিল, একটি এইচকে-৩৩ রাইফেল ও তার দেড়শো রাউন্ড গুলি মালখানের জিম্মায় রয়েছে। তার পর থেকেই পুলিশের ভয় ছিল, মিনিটে ৭৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করতে পারা ওই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে মালখান যে কোনও দিন বড় ধরনের নাশকতা ঘটাবে। বিশেষ করে ভোটের সময়ে ওই ধরনের ঘটনা ঘটালে তার পরিণাম মারাত্মক হবে বলে রীতিমতো আতঙ্কে ছিল পুলিশ। মালদহের দু’টি কেন্দ্রে ভোট হবে ২৪ এপ্রিল। আর ১৭ এপ্রিল উত্তরবঙ্গে ভোট শুরু হচ্ছে। তার আগেই মালখান ধরা পড়ে যাওয়ায় যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল পুলিশের। রাজ্য পুলিশের আইজি (উত্তরবঙ্গ) জাভেদ শামিম বলেন, “এ রাজ্যে লোকসভা ভোট শুরুর চার দিন আগে মালখান সিংহকে গ্রেফতার করাটা আমাদের কাছে স্বস্তির।” তিনি জানান, কেএলও-র ওই নেতাকে ধরার পর তার কাছ থেকে জার্মানিতে তৈরি একটি হেকলার অ্যান্ড কোচ-৩৩ রাইফেল এবং ওই স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ১১২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের দাবি, প্রদীপ রায় ওরফে ইকবাল সিদ্দিকি, নারায়ণ রায় ওরফে তরুণ থাপা, জয়দেব রায় ওরফে টম অধিকারী, মঞ্চলাল সিংহ ওরফে নীলাম্বর রাজবংশীর পরে এ বার মালখানও ধরা পড়ে যাওয়ায় কেএলও-র চেয়ারম্যান জীবন সিংহ আরও অসহায় হয়ে পড়লেন। তদন্তকারীরা জানান, মালখান গত বছর ২৭ ডিসেম্বর হবিবপুরের এগারো মাইলে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে বাসে গুলি চালিয়েছিল। তাতে দুই যাত্রী জখম হন। ওই ঘটনা এবং গত বছর ২৫ জুন গাজলের বিদ্রোহী মোড়ে বোমা বিস্ফোরণ-সহ ন’টি জামিন-অযোগ্য মামলা রয়েছে মালখানের বিরুদ্ধে। কেএলও-র প্রাক্তন কম্যান্ডার-ইন-চিফ, বর্তমানে মূলস্রোতে ফেরা মিল্টন বর্মা নিজেই বলছেন, “মালখানের সমস্যা হল, আগুপিছু না ভেবেই ও ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তাই, ওর থেকে বিপদ বেশি।” তিনি জানান, শারীরিক ভাবে বরাবরই অন্যদের চেয়ে পটু ছিল মালখান।
তবে, মালখানের ডান পায়ে চোট থাকায় তাকে পাকড়াও করা সহজ হয়েছে, জানান রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (মালদহ রেঞ্জ) সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ৩০ মার্চ গাজলের বাগসরাই গ্রামে পুলিশের তাড়া খেয়ে পালানোর সময়ে একটি বড় গর্ত পেরোতে গিয়ে মালখানের ডান হাঁটুতে চোট লাগে। পুলিশের একটি সূত্র যদিও দাবি করছে, মালখানকে ধরা হয় হবিবপুরের জামালপুর জঙ্গল থেকে, কিন্তু পুলিশেরই অন্য সূত্র এবং সিমলা গ্রামের বাসিন্দাদের বক্তব্য, শনিবার রাতে গম্ভীরার আসর চলার সময় রাত ১টা নাগাদ স্থানীয় বাসিন্দা বীরেন বৈশ্যমালির বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ এক জনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জানা যায়, সে মালখান সিংহ।
পুলিশি সূত্রের খবর, হবিবপুরে বাসে গুলি চলার পর থেকে মালখানকে গ্রেফতার করার ব্যাপারে উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিম বিশেষ ভাবে তৎপর হন। গত তিন-চার মাসে তিনি বেশ কয়েক বার মালদহে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। একের পর এক ধরা পড়ে মালখানের সঙ্গীরা। যে-সব লিঙ্কম্যানের মাধ্যমে মালখান মালদহে তোলা আদায় করছিল, তারা তো বটেই, সীমান্তে মালখানের পরিচিত দালালদেরও চিহ্নিত করে ফেলে পুলিশ। ফলে, বাংলাদেশে ঢোকা বন্ধ হয়ে যায় মালখানের। নেপালের ধুলাবাড়ির গোপন আশ্রয়ে থাকা-খাওয়ার জন্য টাকার দরকার ছিল। পুলিশের এক কর্তা বলেন, “টাকা আদায় করতেই ৩০ মার্চ সে মালদহে এসেছিল।”
মালখানকে ধরার জন্য হবিবপুর, বামনগোলা ও গাজল এই তিনটি থানায় পুলিশের বিশেষ দল তৈরি করা হয়। দলগুলি গোপনে কাজ শুরু করে। পুলিশ জানায়, শনিবার রাত ১২টার কিছু পরে বামনগোলা থানার ওসি খবর পান, সিমলা গ্রামে গম্ভীরার আসরে মালখান রয়েছে। ওই আসরে গিয়ে হাজার দুয়েক মানুষের মধ্যে মালখানকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। একটি সূত্রের খবর, বামনগোলা, হবিবপুরের একাধিক মহিলার প্রতি মালখানের দুর্বলতাও তাকে ধরায় সহায়ক হয়েছে। ধৃত কেএলও নেতার কাছ থেকে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের জালনোট ও ৪০ হাজার টাকার আসল ভারতীয় নোট উদ্ধার হয়েছে। মালদহের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।