সাম্প্রদায়িকতার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে সমর্থন করবেন না বলে কয়েক দিন আগেই টিভি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন। এ বার মোদীর নাম না-করেও তাঁর গুজরাত মডেলকে নস্যাৎ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, উন্নয়নের নিরিখে মোদীর গুজরাতের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ অনেক এগিয়ে।
বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাতের মডেলকেই বিপণন করে চলেছেন মোদী। কেন্দ্রে সরকার গড়তে পারলে ওই রাজ্যের মতোই সুশাসন এবং উন্নয়নের সুফল দেশের মানুষ পাবেন বলে সর্বত্রই প্রচার করছেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবেই সংবাদসংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, আসলে গুজরাতের সঙ্গে বাংলার পরিস্থিতির কোনও তুলনাই হয় না। যে সব কঠিন বাধা সামলে তাঁকে এ রাজ্যে উন্নয়নের চাকা ফের সচল করতে হয়েছে, মোদীকে তার কিছুই করতে হয়নি বলে নাম না-করেও দাবি করেছেন মমতা।
তৃণমূল নেত্রী তথা এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, তাঁর উন্নয়নের মডেল গুজরাতের চেয়ে ভাল। এবং তার সুফলও বাংলার মানুষ পাচ্ছেন। উন্নয়নের মডেল নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মমতা বলেছেন, “এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেওয়া যাক। মিঃ এ বা বি-কে কি জঙ্গলমহলের সমস্যা সমাধান করতে হয়েছে? আমরা সেখানে শান্তি এনেছি। মিঃ এ বা বি-র হাতে কি দার্জিলিঙের মতো সমস্যা ছিল? দার্জিলিং এখন হাসছে।” মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “মিঃ এ বা বি-র উপরে কি নিজের রাজ্যের জন্য দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণের বোঝা ছিল? এত কিছু অতিক্রম করেই আমরা কিন্তু উন্নয়নের পথে চলেছি।”
লোকসভা ভোটের আগে উন্নয়নের প্রশ্নে তৃণমূল নেত্রীর এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভোটের পরে সম্ভাব্য সব দরজা খুলে রাখতে তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে নরম মনোভাব নিয়েই চলছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ব্রিগেড সমাবেশে এসে স্বয়ং মোদী বা বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ তেমন বার্তাই দিয়ে গিয়েছেন। হালফিল কলকাতায় এসে বিজেপি-র আর এক কেন্দ্রীয় নেতা বেঙ্কাইয়া নায়ডুও সেই ধারা বজায় রেখেছেন। আর এ সবের প্রেক্ষিতে বাম এবং কংগ্রেস লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে, ভোটের পরে সুযোগ পেলেই ফের বিজেপি-র হাত ধরবে তৃণমূল। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে এই প্রচার প্রভাব ফেলতে পারে বুঝে আগেই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে মোদীকে কয়েক দিন আগেই দূরে সরিয়ে রাখার কথা বলেছিলেন মমতা। তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যায়, এ বার গুজরাতের উন্নয়নের মডেলকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, মোদী সম্পর্কে তাঁর কোনও দুর্বলতাই নেই।
সংবাদসসংস্থাকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যে সমস্যাগুলোর কথা বললাম, রাজ্যে আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার সময় এ সবের ভারই আমাদের নিতে হয়েছে। অন্যান্য রাজ্যে তো কয়েক দশক ধরে উন্নয়নের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে। এখানে কমিউনিস্টরা ৩৪ বছর ধরে ধ্বংস করে যাওয়ার পরে আমরা শুরু করেছি!” ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান, কন্যাশ্রী প্রকল্প বা নেট মারফত সংগ্রহ নীতির উদাহরণ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) নীতি, তথ্যপ্রযুক্তি এবং বস্ত্রনীতির কথা। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, অন্যান্য রাজ্যই বরং তাঁর এ সব নীতি অনুসরণ করলে উন্নতি করবে! উল্লেখ্য, যাদের দোষারোপ করে বাংলার উন্নয়নের মডেলকে তুলে ধরেছেন তৃণমূল নেত্রী, সেই বামেরাও কিন্তু গুজরাতের মডেলকে আদর্শ মানতে নারাজ। তবে তা ভিন্ন কারণে।
গুজরাতের সঙ্গে তুলনার জবাব দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আরও দাবি, এ রাজ্যে তাঁদের ক্ষমতায় আসার সময় পর্যন্ত বছরে গোটা দেশে যত শ্রমদিবস নষ্ট হতো, তার অর্ধেকই ছিল পশ্চিমবঙ্গে। তুলনায় গুজরাতে ভাল কর্মসংস্কৃতি বরাবরের। এখানে গোটা মানসিকতারই পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “অন্য রাজ্যের সঙ্গে বাংলার তুলনা করার আগে এটা বুঝতে হবে! আমরা এই সব কাজ এবং আরও বেশি কিছু করেছি। সেই জন্যই মানুষ আমাদের উপরে আস্থা রাখছেন।” বাংলার নতুন শিল্পনীতিতে যে রকম ‘ইনসেন্টিভ প্যাকেজ’ আছে, তা অন্য যে কোনও রাজ্যের চেয়ে ভাল বলেও দাবি করেছেন মমতা।
বস্তুত, কঠিন সমস্যা পেরিয়ে উন্নয়নের পথে চলার যে কথা মমতা বলেছেন, গত বছর কলকাতায় এসে তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে একই যুক্তি দিয়েছিলেম মোদীও। তখনও তিনি বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষিত হননি। শহরে বণিকসভার অনুষ্ঠানে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ৩৪ বছরের খানাখন্দ মেরামত করে রাস্তা মসৃণ করতে আরও কিছু সময় এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রাপ্য! ঠিক যেমন গুজরাতে তাঁরও সময় লেগেছিল কংগ্রেসর অপশাসনের চিহ্ন মুছতে। সে দিক থেকে দেখলে মোদীর যুক্তিই এ বার মোদীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করলেন মমতা!