সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কয়লা খনি বণ্টন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে নেমেছে সিবিআই। সেই সূত্রেই এ বার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি দল পশ্চিমবঙ্গে আসছে। সিবিআইয়ের যুগ্ম-অধিকর্তা ও পি গোলহোত্রা রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, দেশ জুড়ে কয়লা খনি বণ্টন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ১২টি খনিও রয়েছে। তাই তদন্তের স্বার্থে কলকাতায় গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এ বিষয়ে রাজ্য সরকার যাতে সব রকম সহযোগিতা করে, চিঠিতে সেই আর্জি জানিয়েছেন গোলহোত্রা।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কয়লা উত্তোলনের জন্য রাজ্যকে ১২টি খনি ইজারা দিয়েছিল কেন্দ্র। সেই খনিগুলি বণ্টন করে রাজ্য সরকার। এই কাজ নিয়ম মেনে হয়েছে কি না, সেই তথ্য সংগ্রহ করতেই রাজ্যে আসছে সিবিআই।
খনি বিলি নিয়ে মূল অভিযোগ কী?
শিল্প দফতর সূত্রের খবর, গত কয়েক বছরের বিভিন্ন রাজ্যের আবেদনের ভিত্তিতে শ’খানেক কয়লা খনি বিলি করে কয়লা মন্ত্রক। এই কাজ করা হয় স্টেট ডিসপেনশন রুলস বা সরকারের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তখন ১২টি খনি হাতে পেয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছিল। কোন সংস্থাকে কোন খনি দেওয়া হবে, তা ঠিক হয়েছিল রাজ্য মন্ত্রিসভার শিল্প বিষয়ক সাব কমিটিতে। দফতরের এক কর্তা জানান, সাধারণ নিয়মে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ, ইস্পাতের মতো শিল্পনির্মাণের (যেখানে কয়লার প্রয়োজন হয়) কোনও প্রস্তাব এলে তার জন্য কয়লা খনি চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানাত রাজ্য। কেন্দ্র সব দিক যাচাই করে তাতে সম্মতি দিত। কর্তাটির দাবি, এই পদ্ধতি মেনেই শালবনি ও রঘুনাথপুরে প্রস্তাবিত ইস্পাত ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জিন্দল ও জয় বালাজি গোষ্ঠীর হাতে মোট পাঁচটি ব্লক দরপত্র ছাড়াই তুলে দিয়েছে রাজ্য। একটি খনি দরপত্র ডেকে দেওয়া হয় তিনটি সংস্থা নিয়ে তৈরি বড়জোড়ার ট্রান্স দামোদর কোম্পানিকে। বাকি ছ’টি ব্লক পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম।
নিগমের এক কর্তা জানান, ছ’টি খনিই বেঙ্গল-এমটা নামে যৌথ উদ্যোগের সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বেঙ্গল-এমটা আবার এমটা নামে এক সংস্থাকে খনি থেকে কয়লা তোলার বরাত দিয়েছে। যদিও পুরো কয়লাই সরকারি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির জন্য ব্যবহৃত হয়।
ওই কর্তা জানান, কোনও ব্লকই নিলাম বা দরপত্র চেয়ে দেওয়া হয়নি। সরকার তার নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করেই বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে খনি বণ্টনের এই পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তোলে সিএজি। তাদের রিপোর্টে বলা হয়, অন্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বেসরকারি সংস্থাকে কয়লা খনি দেওয়ার আগে নিলাম বা দরপত্র ডাকার প্রথা অবলম্বন করা হয়নি। তাদের বক্তব্য, শুধুমাত্র মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক করে খনি বিলির সিদ্ধান্ত কখনই স্বচ্ছ্বতার নিদর্শন হতে পারে না। সিএজি-র অভিযোগ ছিল, খনি বণ্টন নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই পদ্ধতিতে খনি বিলি করে এক লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব খুইয়েছে কেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলি। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কয়লা সচিব পি সি পারেখ বণ্টন-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। খনি বিলি নিয়ে দেশ জুড়ে প্রবল বিতর্ক ওঠায় শেষ পর্যন্ত স্ুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কয়লা কেলেঙ্কারি তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে রাজি হয় কেন্দ্রের ইউপিএ-২ সরকার। ২০১২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সিবিআইয়ের ‘ব্যাঙ্ক সিকিউরিটি অ্যান্ড ফ্রড সেল’ তদন্তের কাজ শুরু করে।
এ রাজ্যে তিনটি কয়লা খনি রয়েছে বেসরকারি সংস্থা জিন্দল গোষ্ঠীর হাতে। তাদের প্রতিনিধি বিশ্বদীপ গুপ্ত বলেন, “শিল্প স্থাপনের জন্য কয়লার ব্লক প্রয়োজন ছিল। রাজ্যের কাছে সেই আবেদন করা হয়েছিল। সরকার কোন নীতি মেনে খনি দিয়েছিল— তা তারাই বলতে পারবে। তবে গত দু’বছর ধরে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে দিল্লিতে মন্ত্রকের কাছে ফাইল পাঠানো হলেও তা পড়ে রয়েছে।” জিন্দলদের মতো আরও এক শিল্পগোষ্ঠী জয় বালাজি দু’টি খনি পেয়েছে। তাদের এক মুখপাত্রের বক্তব্য, “নানা জটিলতায় খনি থেকে কয়লা তোলার কাজ শুরুই করা যায়নি! এখন সিবিআই তদন্ত এলে সমস্ত সহায়তা করব। তবে সরকার কী পদ্ধতিতে ব্লক দিয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই।” বিদ্যুৎ নিগমের কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়া যৌথ উদ্যোগের অংশীদার এমটা গোষ্ঠীর কর্তা বিকাশ মুখোপাধ্যায় বলেন, “খনি থেকে কয়লা তুলে নিগমকে সরবরাহ করি। এর বাইরে প্রায় কোনও ভূমিকা নেই। খনির মালিকানাও নিগমের হাতে রয়েছে।’’
খনি বিলি নিয়ে সিবিআই তদন্তে প্রথমে সম্মতি দেয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। এই নিয়ে সরকারের সঙ্গে তদন্তকারী সংস্থার আলাপ-আলোচনা চলাকালীনই সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট সব রাজ্যকে তথ্য দিতে নির্দেশ দেয়। তার পরেই সিবিআইয়ের হাতে যাবতীয় তথ্য তুলে দিতে রাজি হয় নবান্ন। এবং এই কারণে প্রায় দশ ট্রাঙ্ক ভর্তি দলিল-দস্তাবেজ তৈরি রাখা হয়েছে। রাজ্যের শিল্প দফতরের এক কর্তা বলেন, “সিবিআই-এর হাতে সমস্ত নথি, দলিল তুলে দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সে কথা চিঠি লিখে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।” রাজ্য মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কথায়, “তথ্য দেওয়া হলেও আগের সরকারের খনি-বিলির পদ্ধতি নিয়ে কোনও মতামত দেওয়া হবে না।”
তাঁদের আমলে খনি বিলি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সিবিআই আসছে শুনেও রাজ্যের প্রাক্তন পঞ্চায়েত মন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশার মতো রাজ্য কয়লা দিতে চাইছিল না। কিন্তু শুধু যেখানে কয়লা আছে, সেখানেই শিল্প হবে এই ভাবে চলত না। তাই কয়লা ব্লক বণ্টনের সামগ্রিক নীতি তৈরি করার দাবি জানিয়ে আমরা কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিলাম। বাস্তবে তা হয়নি।” সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, সেই সময়ে রাজ্যের বাম সরকার শিল্পায়নের লক্ষ্যে এগোচ্ছিল। কয়লার মতো জরুরি সম্পদ ছাড়া বড় শিল্প করা সম্ভব ছিল না, এই বিবেচনা থেকেই কয়লা ব্লক বণ্টনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
মুখ্যসচিবকে পাঠানো চিঠিতে সিবিআইয়ের যুগ্ম-অধিকর্তার দাবি, যে সব রাজ্যে খনি বিলি হয়েছে সেখানে তদন্ত করতে গেলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সম্মতি লাগে। আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই সম্মতি দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টে তা জানানো হলে সর্বোচ্চ আদালত রাজ্যের সম্মতি ছাড়াই তদন্ত চালানোর নির্দেশ দেয়। তার ভিত্তিতেই রাজ্যে আসছে সিবিআই। রাজ্য সরকারেরও এখন আর এই নিয়ে আপত্তি নেই।