বিষ্ণুপুরের আঁইচবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৪ নম্বর বুথে গত পঞ্চায়েত ভোটে ব্যাপক ছাপ্পার অভিযোগ ওঠে। সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস এ বার একযোগে ওই বুথ স্পর্শকাতর ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বুথে দেখা গেল, এক জন লাঠিধারী এনভিএফ ও দু’জন গাদা বন্দুকধারী রাজ্য পুলিশের কর্মী। ছবি: শুভ্র মিত্র
চিত্র-১
বিষ্ণুপুর, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা
আঁইচবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৪ নম্বর বুথ। পাহারায় একজন লাঠিধারী এনভিএফ ও দু’জন গাদা বন্দুকধারী রাজ্য পুলিশের কর্মী! সিপিএম, কংগ্রেস এবং বিজেপি তিন বিরোধী দলেরই অভিযোগ, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই বুথে তৃণমূল অবাধে ছাপ্পা ভোট দিয়েছিল। বিরোধীরা এজেন্টই দিতে পারেনি। তাই এ বার ওই বুথটিকে স্পর্শকাতর বলে চিহ্নিত করার জন্য লিখিত ভাবে দাবি জানিয়েছিল তারা। যাতে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু ভোট শুরুর ১২ ঘণ্টা আগেও তা হয়নি। বিরোধীদের অভিযোগ, তাঁরা চাইলেও বুথটি স্পর্শকাতর বলে চিহ্নিতই করা হয়নি! জেলা প্রশাসনের মন্তব্য, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চিত্র-২
শালবনি, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা
কুতুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে একটি মাত্র বুথ। এই বুথের কাছেই ২০০৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয় যাওয়ার পথে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল মাওবাদীরা। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বিরোধী দলগুলি এই বুথটিকে স্পর্শকাতর বলে চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কী! ভোট শুরুর ১২ ঘণ্টা আগেও বুথ পাহারায় রাজ্য পুলিশের চার জন সশস্ত্র জওয়ান! বিরোধীদের অভিযোগ, কমিশন ভোটারদের আস্থা বাড়ানোর উপরে জোর দিতে বললেও তা কেবল কথার কথা। আর স্থানীয় প্রশাসনের যুক্তি? কেন্দ্রীয় বাহিনী পাওয়া যায়নি।
চিত্র-৩
বার্নপুর, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা
বার্নপুর বয়েজ স্কুল। এখানে চারটি বুথ। কমিশনের নিয়মে যে ভোট কেন্দ্রে তিনটির বেশি বুথ, সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখানে রয়েছেন রাজ্য সশস্ত্র বাহিনীর জনা চারেক জওয়ান! কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়? বুধবার সকালের মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে পৌঁছবে কি না, সে ব্যাপারে বুথের সশস্ত্র পুলিশের জওয়ানরা কিছু জানেন না। স্থানীয় প্রশাসনের কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তাঁরা বলছেন, মহকুমা প্রশাসনের কাছে খোঁজ নিন!
চিত্র-৪
জেমুয়া, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা
আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের দুর্গাপুরে কালিগঞ্জ প্রাথমিক স্কুল। এখানে ২৩১ এবং ২৩২ নম্বর বুথ দুটি স্পর্শকাতর বলে চিহ্নিত করেছে কমিশন। সোমবার রাতে সিপিএম প্রার্থী বংশগোপাল চৌধুরী প্রচারে আসেন জেমুয়ায়। তার পরে ওই রাতেই মোটরবাইকে চড়ে তৃণমূলের লোকেরা বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীদের। এ নিয়ে সিপিএম থানায় স্মারকলিপিও দিয়েছে। কিন্তু এখনও দেখা নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর। বুথে এক জন করে লাঠিধারী ও সশস্ত্র পুলিশ! পুলিশের অবশ্য দাবি, বুধবার ভোরের মধ্যেই যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কী ভাবে?
চিত্র-৫
জামুড়িয়া, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা
জামুনিয়ার শ্যামলায় নিমসা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে দু’টি বুথ। স্থানীয় প্রশাসন জানে, দু’টি বুথই অতি স্পর্শকাতর। সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই। রয়েছে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ। আসানসোলের কংগ্রেস নেতা চণ্ডী চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, জামুড়িয়া ও পাণ্ডবেশ্বরের অজয় লাগোয়া গ্রামগুলির সব বুথ সংবেদনশীল। সেখানে পঞ্চায়েত ভোটেও সন্ত্রাস হয়েছিল। এই বুথগুলির কথা নির্বাচন কমিশনকে জানানোও হয়েছিল। কিন্তু কোথাওই এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয়েছে রাজ্য পুলিশ।
চিত্র-৬
হিরাপুর, মঙ্গলবার রাত আটটা
হিরাপুরের বিসি রায় কলেজের ১৫৭, ১৫৮ এবং ১৬০ নম্বর বুথে কেবল রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ! এই তিনটি বুথেই গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে বলে গত ৩ মে পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকে দাবি করেছিল একাধিক রাজনৈতিক দল। সেই অনুযায়ী সংবেদনশীল বুথের তালিকাও তৈরি হয়। ঠিক হয়, ওখানে মোতায়েন করা হবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিরোধী দলগুলির প্রশ্ন, জাতীয় নির্বাচন কমিশন এক রকম বলছে, এখানে প্রশাসন অন্য রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে। তা হলে বৈঠকে বসে কী লাভ?
চিত্র-৭
নারায়ণগড়, মঙ্গলবার রাত আটটা
রাজনৈতিক দলগুলির থেকে ‘ওরি লিস্ট’ অর্থাৎ কোন কোন বুথ নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে, জানতে চেয়েছিল কমিশন। সেই অনুযায়ী সংবেদনশীল, অতি সংবেদনশীল বুথ নির্ধারণ এবং আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার কথা। কিন্তু কোথায় কী? পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ের মান্না গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার চাটলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’টি বুথ। সেখানে শুধুই সশস্ত্র পুলিশ। জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি বলেন, “কমিশনের নির্দিষ্ট করা ৫টি ব্যবস্থার মধ্যে একটি ব্যবস্থা সব বুথে অবশ্যই রাখা হবে।”
চিত্র-৮
শালতোড়া, মঙ্গলবার রাত আটটা
বাঁকুড়ার শালতোড়ার আনন্দপুর প্রাথমিক স্কুল। বুথের ধারেপাশে নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোনও জওয়ান। বুথ পাহারার দায়িত্বে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের দুই কর্মী। এখানেই আজ ভোট দেবেন বাগজাদা গ্রামের বাসিন্দারা। বিজেপির অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে মিলে তৃণমূলের লোকেরা গত ক’দিন ধরেই বাগজাদার লোকেদের হুমকি দিচ্ছে। সোমবার রাতে একাধিক বিজেপি কর্মীর বাড়তে হামলাও হয়েছে। মঙ্গলবারও অব্যাহত শাসানি। লাগোয়া আনন্দপুর, রাউতোড়া গ্রামেও বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের তৃণমূল শাসাচ্ছে বলে অভিযোগ এখানকার বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারের। এখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী না আসায় ক্ষুব্ধ সুভাষবাবু সংশয়ে, সুষ্ঠু ভোট হবে তো?
অতঃ কিম্
জাতীয় নির্বাচন কমিশন ভোট নির্বিঘ্ন করতে গুচ্ছ গুচ্ছ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও উপরের ছবিগুলি থেকেই স্পষ্ট, সেই সব নির্দেশ পুরোপুরি মানা হয়নি।
কেন্দ্রগুলির কোথায় কী ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তার হিসেব ছিল না রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্তর কাছে! তাঁর মন্তব্য, “যেখানে যেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি, সেখানে কী ব্যবস্থা হয়েছে, তা বুধবার সকালে জানিয়ে দেব। এখনও সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়নি।”
নিরাপত্তার বেহাল ছবির পাশাপাশি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বিরোধীরা। আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় বলেন, “বুথ চিহ্নিত করার মধ্যেই তো গন্ডগোল রয়েছে।” একই সঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “হারবে জেনে তৃণমূল বাইরে থেকে লোক ঢোকাচ্ছে।” তবে ময়দানে নেমে হাল ছাড়তে নারাজ বাবুল জানান, তিনি নিজের বাড়িতেই রীতিমতো কন্ট্রোল রুম খুলে ফেলেছেন। দলের সব কর্মীকে নিজের ফোন নম্বরও দিয়ে রেখেছেন। ভোটের সময় কোথাও গোলমাল হলেই কর্মীরা যাতে তাঁকে ফোনে জানান, সে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কারণ? “আমি সঙ্গে সঙ্গে ওই সব এলাকায় পৌঁছতে চাই।”
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের মন্তব্য, “এই দফার নির্বাচনে যে পুরোপুরি ভোট লুঠ হবে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। পুলিশ-প্রশাসন শাসক দলের হয়ে কাজ করছে। স্পর্শকাতর বুথের একটা তালিকা বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলির কোনওটিতেই আধাসেনা পাঠানো হয়নি।” কমিশন প্রসঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, “ওরা খালি নির্বিঘ্নে ভোট করানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে।”
ঘাটাল কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়া আবার বলেন, “জেলা প্রশাসন তালিকা তৈরি করে স্পর্শকাতর, অতি স্পর্শকাতর বুথের। তা নিয়ে দল ও প্রার্থীদের সঙ্গে কথা হয়। তার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হয়। গোপনে কী তালিকা তৈরি হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার।”
বিরোধীদের সমবেত অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওদের অবস্থা হয়েছে রাখাল বালকের মতো! বাঘ বাঘ পড়েছে বলে চিৎকার করছে। আসলে ওদের মিথ্যাচার ও কুৎসা করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই।”