পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে রাজনাথ সিংহ। ছবি: কিংশুক আইচ।
ক’দিন আগেই নরেন্দ্র মোদী এসে আক্রমণের সুর তীব্র করে দিয়ে দিয়েছিলেন। যার প্রেক্ষিতে প্রতিদিনই মোদীকে কড়া পাল্টা আক্রমণ করছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু শুক্রবার রাজ্যে প্রচারে এসে তৃণমূল নেত্রীর প্রতি নির্দিষ্ট বার্তা দিয়ে গেলেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিড়লাপুর এবং উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি কলকাতা সংলগ্ন দুই এলাকার দু’টি সভায় রাজনাথ মমতাকে পরামর্শ দিয়েছেন বিজেপি-র সঙ্গে সংঘাতে পথে না যাওয়ার। তাঁর আশ্বাস, কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে একমাত্র বিজেপি-র সরকারই পারে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের কথা বিবেচনা করতে। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের কাছে রাজ্যের ঋণের উপরে সুদ মকুবের (মোরাটরিয়াম) দাবি জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি বলে বারবারই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর ওই দাবিকে ন্যায়সঙ্গত বলে তিন মাস আগে ব্রিগেডে এসে মন্তব্য করেছিলেন রাজনাথই। কিন্তু এখন ভোট-পর্ব চলাকালীন ও মোদীর চড়া সুরের মধ্যে তাঁর এই অবস্থান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই বিজেপি সূত্রের ব্যাখ্যা।
ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাসের সমর্থনে প্রচারে এসে বিড়লাপুরে রাজনাথ বলেন, “মমতাজি, সিপিএমের সঙ্গে ঝগড়া করুন আপনি। বিজেপি সিপিএমকে নিয়ে সরকার করবে না। কংগ্রেস আপনার স্পেশাল আর্থিক প্যাকেজের ব্যবস্থা করেনি। সরকার গঠন করলে বিজেপি-ই হয়তো তা করতে পারে।” আগে ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থী রুমেশ কুমার হান্ডার সমর্থনে নৈহাটির সভায় দলের সর্বভারতীয় সভাপতি বলেন, “মমতাকে একটা প্রশ্ন আছে। মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে কংগ্রেস লড়ে না। বিজেপি লড়ে। তা হলে বিজেপি-র সঙ্গে লড়াই করছেন কেন? বরং, কংগ্রেস আর সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করুন।” এই সঙ্গেই রাজনাথের বার্তা, “বিজেপি দিল্লিতে সরকার গড়লে এ রাজ্যের জন্য সব থেকে বড় প্যাকেজ দেব।”
কেন্দ্রীয় বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে রাজনাথ ভেবেচিন্তেই এমন বার্তা দিয়েছেন। রাজনাথের সঙ্গে এমনিতে তৃণমূল নেতৃত্বের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভাল। সেই কূটনীতির পথ কাজে লাগিয়েই গত বছর হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রার্থী প্রত্যাহার করতে বিজেপি-কে রাজি করিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দিল্লিতে বিজেপি নেতৃত্বের ইঙ্গিত, এখন লোকসভা ভোটের প্রচারে কিছু ঘাত-প্রতিঘাত হলেও পরে সরকার গড়ার প্রয়োজনে সম্ভাব্য বন্ধু হিসাবে মমতা বা নীতীশ কুমারের মতো আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীদের জন্য একেবারে দরজা বন্ধ করেননি রাজনাথেরা। সকলের কথাই মাথায় রাখা হচ্ছে খোলা মনে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন বামেদের আসন বাড়লে বিজেপি-র কোনও লাভ নেই। বরং, তৃণমূল আসন পেলে পরবর্তী কালে ঘুরপথে বিজেপি-র কিছু লাভ হলেও হতে পারে। তবে এই অঙ্কের পাশাপাশিই মোদীকে মমতার আক্রমণ প্রসঙ্গে দিল্লিতে এ দিন বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি বলেছেন, “কোনও অবরোধেই মোদীর রাস্তা আটকাবে না!”
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, “শ্রীরামপুরে মোদী এক রকম কথা বলছেন, আর বিড়লাপুর বা নৈহাটিতে রাজনাথ অন্য রকম বলছেন! আগে বিজেপি নিজেদের লাইন ঠিক করুক!” তাঁর বক্তব্য, “সাম্প্রদায়িক বিজেপি-র সঙ্গে আমাদের কোনও লাইন নেই। এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য, কংগ্রেস-বিজেপি-সিপিএমকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রে এমন এক সরকার গড়া, যারা বাংলার স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করবে না।”
মোদী-মমতা সংঘাত তুঙ্গে ওঠার পর থেকেই বামেরা অবশ্য দাবি করে আসছে, গড়াপেটার খেলা চলছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কথায়, “তৃণমূল আগে বিজেপি-র সঙ্গে ছিল। ভবিষ্যতেও তারা আবার ও’দিকে যাবে না, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এখন সাম্প্রদায়িক ভাবে ভোটের মেরুকরণ ঘটানোর জন্য তারা একে অপরকে আক্রমণ করছে।” বিমানবাবুদের ব্যাখ্যা, মোদীকে আক্রমণ করে তৃণমূল নেত্রী সংখ্যালঘুদের মন জয় করতে চাইছেন। আর বিজেপি চাইছে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক করায়ত্ত করতে। একই ভাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মত, “তৃণমূল নেত্রী যখনই বুঝেছেন সংখ্যালঘুরা তাঁকে বিশ্বাস করছেন না, তখনই বিজেপি-র সঙ্গে ম্যাচ ফিক্সিং করে আক্রমণ করছেন!” রাজনাথের এ দিনের বক্তব্যে তাঁদের এই ব্যাখ্যাই ঠিক প্রমাণিত হল বলে বাম-কংগ্রেসের বক্তব্য।
তবে রাজনাথ এ দিন রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্নে সিপিএম ও তৃণমূলকে একই সুরে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, “৩৪ বছরে সিপিএম তেমন উন্নয়ন করতে পারেনি। এখন তৃণমূল সরকারও উল্লেখযোগ্য কোনও কাজ করতে পারেনি। এখানে এখন উন্নয়ন নয়, তৃণমূল আর সিপিএম মহাভারতের মল্লযুদ্ধ করে চলেছে!”