২১ জুলাই তদন্ত রিপোর্ট

কার নির্দেশে গুলি জানা যায়নি, নিশানায় মণীশ

তিন বছর সময় লেগেছে। ৫৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার নির্দেশে গুলি চলেছিল, সেই প্রশ্নটারই উত্তর মিলল না ২১ জুলাই কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে। ১৯৯৩ সালের ১২ জুলাই কলকাতার রাজপথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে মহাকরণ অভিযানে সামিল হওয়া যুব কংগ্রেস কর্মীদের উপরে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এই ঘটনায় মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। তার পর থেকে ওই দিনটি শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন মমতা। ক্ষমতায় আসার পরেই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ২১ জুলাইয়ের ঘটনার তদন্তে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিলেন তিনি। সোমবার তার রিপোর্ট জমা পড়েছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৬
Share:

রিপোর্ট পেশ করলেন কমিশনের চেয়ারম্যান। নিজস্ব চিত্র

তিন বছর সময় লেগেছে। ৫৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার নির্দেশে গুলি চলেছিল, সেই প্রশ্নটারই উত্তর মিলল না ২১ জুলাই কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টে।

Advertisement

১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই কলকাতার রাজপথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে মহাকরণ অভিযানে সামিল হওয়া যুব কংগ্রেস কর্মীদের উপরে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। এই ঘটনায় মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। তার পর থেকে ওই দিনটি শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন মমতা। ক্ষমতায় আসার পরেই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ২১ জুলাইয়ের ঘটনার তদন্তে বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠন করেছিলেন তিনি। সোমবার তার রিপোর্ট জমা পড়েছে। রিপোর্টে গুলিচালনাকে ‘অবৈধ, অনৈতিক, অসাংবিধানিক’ বলে মন্তব্য করেছে কমিশন। কিন্তু কে ওই ‘অবৈধ, অনৈতিক, অসাংবিধানিক’ কাজের জন্য দায়ী, সেটা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি। তিন বছর ধরে তদন্তের পর কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, “পুলিশ কী করে গুলি চালাল, ইতিহাসই তার বিচার করবে।”

কমিশন তা হলে তদন্ত করে কী জানল? রিপোর্টে এই ঘটনাকে প্রশাসনের সামগ্রিক ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করে কমিশন জানিয়েছে, তৎকালীন মহাকরণ ও লালবাজারের কর্তারা ঘটনার দায় অস্বীকার করতে পারেন না। এই প্রসঙ্গে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব, বর্তমান মন্ত্রী মণীশ গুপ্তর ভূমিকা নিয়ে বরং কিছু প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অর্থাৎ কমিশন গঠনের পিছনে যে মূল উদ্দেশ্য গুলি চালানোর নেপথ্যে মূল মস্তিষ্ক কার ছিল, সেটা সামনে আনা সেটা এ দিনের রিপোর্টে তেমন ভাবে উঠে আসেনি। তার মধ্যে মণীশবাবুর ভূমিকা নিয়ে আলাদা প্রশ্ন ওঠায় কার্যত বর্তমান সরকারের অস্বস্তিই বাড়িয়েছে কমিশন।

Advertisement

কী রকম? কমিশনে সাক্ষ্য দিতে এসে রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশবাবু জানিয়েছিলেন, গুলি চালানোর ঘটনা তিনি সমর্থন করেন না। বিষয়টি তিনি জানতেন না বলেও দাবি করেছিলেন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব। কিন্তু তাঁর রিপোর্টে কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন, “গুলি চালানোর ঘটনা স্বরাষ্ট্রসচিব জানবেন না, এটা হতে পারে না।”

কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান এ দিন তাই কটাক্ষ করে বলছেন, “আগের সরকার এতগুলো মানুষকে খুন করেছিল। এই সরকার খুনিদের পুরস্কৃত করেছে! যারা এই কমিশন গড়েছে, তারাই সেই আমলের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নেতা-মন্ত্রী করে বসিয়েছে!” রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব ও বর্তমান মন্ত্রী সত্য কথা বলছেন কি না, তা নিয়ে আমাদের ঘোর সন্দেহ রয়েছে।” মণীশবাবু নিজে এ দিন একটি সরকারি বৈঠকে যোগ দিতে কোচবিহার গিয়েছিলেন। পরে সার্কিট হাউসে তিনি বলেন, “যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে আর কথা নেই।”

কিন্তু গুলিচালনা সংক্রান্ত মূল প্রশ্নটি যে অমীমাংসিত রয়ে গেল, তার কী হবে? নবান্ন সূত্রের খবর, স্বরাষ্ট্রসচিবের দফতরে রিপোর্টটি জমা পড়লেও স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জঙ্গলমহল সফরে রয়েছেন। তাই তিনি রিপোর্ট দেখতে পারেননি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও কমিশনের রিপোর্ট দেখেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “২১ জুলাই আমরা যা দেখেছি, যা জানি, তার সঙ্গে রিপোর্টের মিল আছে কি না, সে সব দেখতে হবে। পুরোটা না জেনে মন্তব্য করা উচিত হবে না।”

মান্নান অবশ্য সরাসরিই প্রশ্ন তুলছেন, “জনগণের টাকায় এই কমিশনের প্রহসন করে তা হলে কী লাভ হল?”

কমিশনের বক্তব্য, ২১ জুলাইয়ের ঘটনা নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট উধাও হয়ে গিয়েছে। সেটা হাতে পেলে অনেক কিছু বোঝা যেত।

কোথায় গেল সেই রিপোর্ট? তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই জানিয়েছিল, রিপোর্টটি নেই। কমিশনে সাক্ষ্য দিতে এসে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রিপোর্ট খুঁজে বের করুক নতুন সরকার। প্রয়োজনে তদন্ত হোক।

কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার তুষার তালুকদার অবশ্য এই কমিশনকে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। তাতে ৭৫ রাউন্ড গুলি চালানোর কথা জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু গুলি চালনার নির্দেশ কে দিয়েছিলেন, তা সেখানে স্পষ্ট নয়। লালবাজার কন্ট্রোল থেকে এমন কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি বলে ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে বিক্ষোভের জন্য যে পুলিশি বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, তাতেও গুলি চালানোর কথা ছিল না। গোলমাল শুরুর পর লালবাজার থেকে একটি অতিরিক্ত বাহিনী গিয়েছিল। তারাই গুলি চালিয়েছিল বলে কমিশন জেনেছে।

কমিশনের মতে, পুলিশ ইচ্ছে করলে সে দিন গুলি চালানো এড়াতে পারত। লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা যেতে পারত। এ প্রসঙ্গে দিল্লিতে নির্ভয়া কাণ্ডের সময় বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার উদাহরণও টানা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সরকারকে যথোপযুক্ত তদন্ত এর পর করার সুপারিশ করেছে কমিশন। কলকাতা পুলিশের সে দিনের ভূমিকা নিয়ে এ দিন তুষারবাবুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমি এখনই কোনও মন্তব্য করব না।” প্রাক্তন সিপি-র ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, ২১ জুলাই নিয়ে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা করেছেন। সেই কারণেই এখন এ নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে চাইছেন।

২১ জুলাইয়ের ঘটনার সময় রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু শুধু বলেন, “এ নিয়ে কিছু আর বলতে চাই না। দলের তরফে যা বলার সূর্যকান্ত মিশ্র বলবেন।”

সূর্যবাবু পরে বলেন, “কমিশনের রিপোর্ট এখনও আমরা কেউ হাতে পাইনি। তবে সংবাদমাধ্যম থেকে যা জেনেছি, তার ভিত্তিতে আমাদের প্রশ্ন, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, যিনি তখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে মহাকরণ দখল অভিযান কি সাংবিধানিক রীতি মেনে হয়েছিল? এ ব্যাপারে কমিশনের বক্তব্য কী?”

কমিশনের বক্তব্য, সে দিন বিক্ষোভকারীরা মহাকরণের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। মহাকরণের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কানোয়ালজিৎ সিংহ নামে এক আইপিএস অফিসার কমিশনকে জানিয়েছিলেন, সে দিন মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব নির্বিঘ্নেই মহাকরণে ঢুকেছিলেন। রিপোর্ট বলছে, মেয়ো রোডে পুলিশের গুলিতে ৬ জন মারা গিয়েছিলেন। ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে মারা গিয়েছিলেন ৬ জন (পরে এক জন অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান)। “দু’টো ঘটনাস্থলই মহাকরণ থেকে অনেক দূরে,” মন্তব্য করেছেন বিচারপতি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ২১ জুলাইয়ের ঘটনাকে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের’ থেকেও সাংঘাতিক বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। নিহতদের পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা করে এবং আহতদের ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় মনে করছেন, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, আমরা এত দিন ধরে যা অভিযোগ করে আসছিলাম, কমিশন প্রায় সে কথাই বলেছে।”

কমিশনের তদন্ত পদ্ধতি নিয়েও অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন সূর্যকান্ত। তিনি বলছেন, সে দিনের ঘটনার মূল হোতা, রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে কমিশনে ডাকাই হল না! ‘‘এটা কী রকম প্রক্রিয়া!” কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য, “ওঁকে (মমতাকে) ডাকার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে পাইনি।” কমিশনের একটি সূত্রে এও বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী কমিশন তৈরির নির্দেশ দেওয়াতেই তাঁকে ডাকা হয়নি। যদিও সূর্যবাবুর দাবি, এ ধরনের কমিশন গঠন করতে গেলে রাজ্যপালের সই লাগে। এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement