অনেক জল্পনার পরে পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের চিকিৎসার জন্য তৈরি হল মেডিক্যাল বোর্ড। আর সেই বোর্ড তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খেলেন এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ।
কেন? কারণ, সারদা কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়া মন্ত্রীর মেডিক্যাল বোর্ডে থাকতে চাইছেন না অধিকাংশ চিকিৎসকেরাই। শেষ পর্যন্ত যাঁরা বোর্ডের সদস্য হয়েছেন, তাঁরাও রীতিমতো শঙ্কিত এবং দৃশ্যতই উদ্বিগ্ন। কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলেই বলে দিচ্ছেন, “কিচ্ছু বলার নির্দেশ নেই। কথা বললেই বিপদে পড়ব।”
হাসপাতাল সূত্রে বলা হচ্ছে, মদন মিত্রের অসুস্থতার প্রকৃত অবস্থা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হওয়ায় এবং বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করায় স্বাস্থ্য দফতর এবং চিকিৎসকেরা বিব্রত। ডাক্তারদের এই অনীহার পিছনে মূল কারণ সেটাই। এ নিয়ে অযথা বিতর্ক এড়াতে শনিবার থেকেই একের পর এক ডাক্তার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা মেডিক্যাল বোর্ডে থাকতে চান না। ফাঁপরে পড়ে যান এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। গত মাসে এক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে মন্ত্রী এসএসকেএমে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তখনও একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। এ বারও সেই পুরনো বোর্ডই রাখা হবে বলে প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসকেরা বেঁকে বসায় বোর্ডের সদস্যদের রদবদল করতে বাধ্য হন তাঁরা।
এর মধ্যেই এ দিন আদালতে কুণাল ঘোষের মন্তব্যের পরে আরওই বেঁকে বসেন চিকিৎসকেরা। পরিবহণমন্ত্রীর নাম উল্লেখ না-করে কুণাল সিবিআই আদালতের বিচারকের সামনে বলেন, “এটা জীবন-মরণ সমস্যা। চারপাশে দেখে মনে হচ্ছে, যাঁদের হাতে টাকা আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, তাঁদের জন্য জেলের অর্থ এক রকম, বাকিদের জন্য অন্য রকম। এক জন তো হোটেলে আছেন! হাসপাতাল থেকে ফোনে কথা বলছেন। তিনি যে হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির সভাপতি, সেই হাসপাতালেই তাঁকে রাখা হচ্ছে। তা হলে ওঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন!” এই সময়ে বিচারক তাঁকে থামিয়ে বিষয়টি লিখিত ভাবে দিতে বলেন।
মদনের এই কারাবাসের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে এ দিন কুণালের মতোই মুখ খুলেছেন বিরোধীরাও।
সিপিএম নেতা অঞ্জন বেরাও এ দিন মন্তব্য করেন, “হাসপাতালগুলো এখন তৃণমূল নেতাদের হলিডে-হোম।” এই সব মন্তব্য টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পরে আরও শঙ্কিত এবং সতর্ক হয়ে যান চিকিৎসকেরা। হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “আমাদের তো ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা।”
সোমবার মদনবাবুর স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলেই তাই ডাক্তারবাবুরা কার্যত পালিয়ে যাচ্ছেন বা আঁতকে উঠে, অতি-সতর্ক হয়ে গম্ভীর মুখে বলছেন, “কিছু বলা বারণ। বললেই বিপদে পড়ব।” কয়েক জন চিকিৎসক মুখ খুললেও অনেকেই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। এক চিকিৎসক বললেন, “স্বাস্থ্য ভবনের শীর্ষ কর্তারা বারণ করে দিয়েছেন। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, মদন মিত্রের শারীরিক অবস্থা নিয়ে একটা শব্দও সংবাদমাধ্যমকে বলা যাবে না। খুব ফেঁসে গিয়েছি। রামায়নের মারীচের মতো অবস্থা! এ দিকে সুপ্রিম কোর্ট-সিবিআই, ও দিকে নবান্ন!”
গত বার মন্ত্রীর বোর্ডে ছিলেন বক্ষ বিশেষজ্ঞ সোমনাথ কুণ্ডু ও ঋতব্রত মিত্র, এন্ডোক্রিনোলজিস্ট শুভঙ্কর চৌধুরী, সার্জারির বিতান চট্টোপাধ্যায়, মনোচিকিৎসক প্রদীপ সাহা, নিউরোলজিস্ট গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়, মেডিসিনের নির্মলেন্দু সরকার। আর সোমবার যে নতুন বোর্ড তৈরি হয়েছে তাতে পুরনো বোর্ডের রয়েছেন শুধু সোমনাথ কুণ্ডু এবং প্রদীপ সাহা। তা ছাড়া আছেন, কার্ডিওলজিস্ট শিবানন্দ দত্ত, নেফ্রোলজিস্ট রাজেন্দ্র পাণ্ডে, এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, নিউরোলজিস্ট অলোক পণ্ডিত এবং ইউরোলজিস্ট দিলীপ কুমার পাল।
কেন ঋতব্রতবাবু, বিতানবাবু, শুভঙ্করবাবু, গৌতমবাবু বা নির্মলেন্দুবাবুকে এ বারের বোর্ডে রাখা হল না?
এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের ব্যাখ্যা, “সব সময় সবাইকে পাওয়া যাবে এমন নয়। অনেকে ছুটিতে রয়েছেন। আবার যিনি বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন, তিনি যাঁকে মনে করবেন, তাঁকে মনোনীত করতে পারেন। সবটাই পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে।” এ বার বোর্ডে নেই এমন এক চিকিৎসক অবশ্য হেসে বললেন, “মদনবাবুর রোগের পরিবর্তন হচ্ছে না, কিন্তু মেডিক্যাল বোর্ডের ডাক্তারদের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এই বোর্ডে থাকা মানে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। কে এই হ্যাপা নেবে? তাই আমি থাকতে চাইনি।”
যাঁরা নতুন বোর্ডে রয়েছেন
তাঁরাও অতি সতর্ক। চিকিৎসক শিবানন্দ দত্তর কথায়, “বলতে চাইলেও বলতে পারব না। বারণ আছে। বয়স হয়েছে। এই বয়সে বিপদে পড়তে চাই না। আমাকে ক্ষমা করো।” একই অবস্থা রাজেন্দ্র পাণ্ডেরও।
করুণ মুখে বললেন, “বোর্ডে রয়েছি। কিন্তু মন্ত্রীর স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও কথা বলতে পারব না। বললে চাকরি চলে যেতে পারে। বড় বড় আইএএস অফিসারেরা কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে চলে যাচ্ছেন, আমরা কোন ছার!” বোর্ডের ডাক্তারদের প্রত্যেকেরই এক কথা “যদি কিছু বলতে হয় তা হলে অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্র বলবেন।” শুনে জোরে জোরে মাথা নাড়েন প্রদীপবাবু, “অসম্ভব। কোনও প্রশ্নই নেই। এই করতে গিয়ে হাসপাতালের অন্য কোনও কাজ করতে পারছি না। মদন মিত্র নিয়ে কোনও কথা বলব না। এত দিন বলে খুব ভুল করেছি, সেটা টের পাচ্ছি। এ বার থেকে মেডিক্যাল বোর্ড যা জানাবে, তা প্রতিদিন শুধু জেল কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। আমরা বিপদে পড়তে চাই না।”
এসএসকেএম সূত্রের খবর, আজ, মঙ্গলবার থেকে মদনবাবুর বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করবেন চিকিৎসকেরা। বোর্ডের কাছে মন্ত্রী জানান, বুকে মাঝেমধ্যেই ব্যথা হচ্ছে। তা ছড়াচ্ছে বাঁ-হাতেও। রাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আর প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে। সঙ্গে গলা টিপে ধরছে বলে মনে হওয়া, ঘুম না-হওয়া এবং হাত-পা কাঁপার সমস্যা আছে। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহল সূত্রের খবর, প্রথম দিনে যে ভাবে হাসপাতালের কেবিনে অনুগামীদের আনাগোনা শুরু হয়েছিল, তা নিয়েও বিব্রত তাঁরা। রবিবার থেকে তা বন্ধ। এ দিনও মন্ত্রীর কেবিনের আশপাশে পুলিশের পাহারা ছিল। ডাক্তার ও পরিবারের কাউকে ছাড়া তাঁর সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।