কেন্দ্রীয় বেতন অমিল, ধুঁকছে সংস্কৃতি জগত

ঝাড়গ্রামের ঝুমুর শিল্পী শক্তি মাইতি। নানা রকম ঢোল-বাঁশিও বাজাতেন। এখন একশো দিনের কাজ আর সামান্য চাষ করেন। বসেন বাজারে সব্জি বেচতেও। ঘাটালের ক্ষীরপাইয়ের যুবক শম্ভু সোরেন। ঢোল, ধামসা, নাকাড়া বাজাতেন।

Advertisement

সোহিনী মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৭
Share:

ঝাড়গ্রামের ঝুমুর শিল্পী শক্তি মাইতি। নানা রকম ঢোল-বাঁশিও বাজাতেন। এখন একশো দিনের কাজ আর সামান্য চাষ করেন। বসেন বাজারে সব্জি বেচতেও।

Advertisement

ঘাটালের ক্ষীরপাইয়ের যুবক শম্ভু সোরেন। ঢোল, ধামসা, নাকাড়া বাজাতেন। এখন একশো দিনের কাজ, চাষবাস করেন।

নারায়ণগড়ের ফটিক মিদ্দা। রবীন্দ্রভারতী থেকে নাটকে এমএ। এখন চাষবাস করে সংসার টানছেন।

Advertisement

সংসার চালাতে প্রত্যেককেই খুঁজে নিতে হয়েছে অন্য পেশা। যার জন্য শিল্পীরা দুষছেন কেন্দ্রীয় সরকারের গাফিলতিকেই। অভিযোগ, দেড় বছর ধরে দেশীয় শিল্পকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি বেতনভাতা বা ‘স্যালারি গ্রান্ট’টি বন্ধ। ফলে সমস্যায় পড়েছেন হাজার হাজার শিল্পী এবং দল।

কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক নাটক, নাচ, গান, শিশুদের নাট্যদল বা একক শিল্পীদের ‘পারফর্মিং আর্টস গ্রান্টস স্কিম’-এর আওতাভুক্ত করে। এই প্রকল্পেই দেওয়া হয় ‘প্রোডাকশন গ্রান্ট’ এবং ‘রেপার্টরি গ্রান্ট’। নতুন বা বিশেষ প্রযোজনা ‘প্রোডাকশন গ্রান্ট’ হিসেবে পায় বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকা। আর ‘রেপার্টরি গ্রান্ট’-এর ক্ষেত্রে একটি দলের সর্বাধিক ২৫ জন সদস্য প্রতি মাসে ‘স্যালারি গ্রান্ট’ হিসেবে ৬০০০ টাকা করে পান। গুরু বা পরিচালক পান ১০,০০০ টাকা। গোটা টাকাটাই এক বছরের হিসেবে একলপ্তে দেওয়া হয়। এক আর্থিক বর্ষের টাকা মেটানো হয় পরের আর্থিক বর্ষে। গোটা পদ্ধতিটি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। অভিযোগ, গত দেড় বছর ধরে টাকা আসা বন্ধ। ‘ডান্সার্স গিল্ড’-এর পার্বতী গুহ, ‘নান্দীপট’-এর প্রকাশ ভট্টাচার্য, ‘পদাতিক ডান্স সেন্টারে’র সহ-সম্পাদক স্বপন মিত্রদের দাবি, বিগত সরকারের শেষ পর্ব থেকেই গ্রান্ট প্রদানের প্রক্রিয়ায় অনিয়ম শুরু হয়। বর্তমান আমলেও তা জারি রয়েছে। ‘মণিপুরি নর্তনালয়ে’র বিম্বাবতীদেবী, ‘মমতা শঙ্কর ডান্স কোম্পানি’র চন্দ্রোদয় ঘোষেরা বলছেন, “গ্রান্টের টাকাটা এমনিতেই সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরির হারের চেয়েও বহু কম। তার উপর ওই টাকা কেন দেড় বছর ধরে বন্ধ, কবেই বা চালু হবে— এ ব্যাপারে সরকারের তরফে কোনও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি।’’ উদ্বেগ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব তথা প্রসার ভারতীর বর্তমান সিইও জহর সরকারও বলছেন, “মন্ত্রকের বর্তমান কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ব্যাপারটি দুঃখজনক।”

কেন এই সমস্যা?

মুখে কুলুপ এঁটেছে মন্ত্রক। তবে বিভিন্ন সংস্থা এবং শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাচ্ছে, গত বছর মার্চে ২০১৩-’১৪ আর্থিক বর্ষের টাকা মেলার পরে আর কোনও টাকা পাননি শিল্পীরা। ২০১৪-’১৫ আর্থিক বর্ষের টাকা এখনও বাকি। ২০১৫-’১৬ আর্থিক বর্ষের টাকাও পরের বছর মিলবে কি না, তা নিয়ে ধন্দে শিল্পীরা। অর্থাৎ, প্রায় ১৮ মাস ধরে কার্যত বিনা বেতনে কাজ করে চলেছেন সংস্কৃতি জগতের বহু মানুষ। শিল্পীদের ক্ষোভ, দফতরে যোগাযোগ করলে কোনও সদুত্তর মিলছে না।

অনেক আবার প্রশ্ন তুলেছেন, গ্রান্ট দেওয়ার প্রচলিত পদ্ধতি নিয়েই। অনলাইন ব্যবস্থার দাবিও তাঁরা তুলেছেন। প্রচলিত পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন রাজ্য থেকে এ বছরই ওই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হওয়া নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তীও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যোগ্য দল বা গুরুই যে গ্রান্ট পান, তার নিশ্চয়তা নেই। গোটা পদ্ধতিটাই নতুন করে সংস্কার দরকার।’’ পাশাপাশি তাঁর দাবি, সম্প্রতি কমিটি বৈঠকে বসেছে। শীঘ্রই গ্রান্ট দেওয়া হবে বলে তিনি আশা করছেন।

কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে দেশের অজস্র সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়ার মুখে। কোনও দল জমানো টাকা দিয়ে, কোথাও দলের পরিচালকরা নিজেদের টাকায় দল চালাচ্ছেন। বড় সংস্থাগুলি তা-ও বেসরকারি স্পনসর পান। নতুন বা ছোট সংস্থাগুলির ভাগ্যে সেই শিকে বেশি ছেঁড়ে না। তাই সব থেকে বেশি বিপাকে পড়েছেন ওই সব সংস্থার হাজার হাজার শিল্পী। রুজিরুটির জন্য অনেকেই অন্য পথ খুঁেজ নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের সর্বত্রই কমবেশি এক অবস্থা। মহারাষ্ট্রের মোহিনীঅট্টম শিল্পী কনক রেলে, দিল্লি ও তামিলনাড়ুর ভরতনাট্যম শিল্পী গীতা চন্দ্রন, চিত্রা বিশ্বেশ্বরনদের ক্ষোভ, “আমরা যে শিল্পচর্চা করি, তা টিকিয়ে রাখতে এই টাকা কিছুই নয়। অথচ দলের সদস্যদের সেটুকু টাকা দিতেও সরকার রাজি নয়!” ওড়িশি নৃত্যগুরু শর্মিলা বিশ্বাসের আশঙ্কা, শিল্পচর্চা শুধুই ধনীদের বরাদ্দ বিষয় হয়ে যাচ্ছে। কথক শিল্পী বিক্রম আয়েঙ্গারের অভিযোগ, “সঙ্কটের এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রক থেকে ফোন করে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের জন্য প্রোডাকশন তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে। আমরা স্বাধীন ভাবে শিল্পচর্চা করে এসেছি। কোনও দিন এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়িনি।”

এ ক্ষেত্রে বড় শহরের বাইরের দলগুলির অবস্থা আরও শোচনীয় বলে জানাচ্ছেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। পশ্চিম মেদিনীপুরের ‘ষড়ভুজ’ বা উত্তর ২৪ পরগনার ‘গোবরডাঙা নকশা’-র মতো দলগুলি গ্রান্ট না পেয়ে রীতিমতো ধুঁকছে। অভিনেতা গৌতম হালদারের কথায়, “আমার দলেরই এক সদস্য প্রতিদিন বনগাঁ থেকে মহলা দিতে আসেন। যাতায়াত, খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে একশো টাকার উপর খরচ। মাসে ৪ হাজার টাকা ওতেই চলে যায়। এই সব শিল্পীর কাছে গ্রান্টের এই সামান্য টাকাটাই জীবনধারণের একটা বড় অংশ।” ‘কল শো’ থাকলেও কেন্দ্রীয় গ্রান্ট না পেয়ে অবস্থা খারাপ হচ্ছে বড় দলগুলিরও। ‘রঙ্গকর্মী’র ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘‘এ ভাবে চললে বেশি দিন দল টিকিয়ে রাখা যাবে না।’’ ধার করে চলছে ‘নান্দীকার’ও। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলছেন, “আমরা তো ভাতা পাই না, যোগ্যতার মাইনে পাই। অন্য কোনও ক্ষেত্রে বেতন বন্ধ হয়ে গেলে শোরগোল পড়ে যেত।’’ ‘স্বপ্নসন্ধানী’র কৌশিক সেনের বক্তব্য, এই ধরনের শিল্পের পরিচর্যা নিয়ে সরকারের অনাগ্রহ বহু দিনের। কিন্তু সরকার পাশে না থাকলে টিকে থাকা খুবই মুশকিল।

কলকাতা থিয়েটারের দুই পরিচিত ব্যক্তিত্ব এখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তার মধ্যে ব্রাত্য বসুর ক্ষোভ, ‘‘কেন্দ্র এই ধরনের শিল্পচর্চাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে। তাই গ্রান্ট দিতে গড়িমসি করছে।’’ অন্য দিকে সাংসদ অর্পিতা ঘোষ বলছেন, “আমি নিজে মন্ত্রী এবং সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। লোকসভাতেও বিষয়টি তুলেছি।’’ তার পরেও ছবিটা বদলাল না কেন?

দফতরে ফোন করা হলে বারবারই বলা হচ্ছে, মন্ত্রী মহেশ শর্মা বাইরে রয়েছেন। মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব অরবিন্দ মনজিৎ সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে মন্ত্রকের এক আধিকারিকের দাবি, সেপ্টেম্বরের পরেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কেন্দ্রে রাজ্যের একমাত্র মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র আশ্বাস, “লিখিত অভিযোগ পেলে সমস্যার সমাধানের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement