সাড়ে ৭৮ হাজার কোটি পর্যন্ত গেলেন না। ঘোরাফেরা করলেন ২৭ হাজার কোটিতেই। পাঁচ মাস পরে বুধবার টাউন হলে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের কাজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা পর্যালোচনা বৈঠকের নির্যাস এটাই।
সংখ্যা দু’টো কাল্পনিক নয়। ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে রাজ্য বাজেটে পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওয়া অর্থ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাজার থেকে নেওয়া ঋণের অঙ্ক যোগ করলে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৭৮ হাজার কোটি। এই মোট টাকাটাই গত বছর রাজ্যের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে খরচ হওয়ার কথা। ফলে সরকারের বিভিন্ন দফতর এবং জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের ডেকে উন্নয়ন প্রকল্পের হাল হকিকত জানার সময় মুখ্যমন্ত্রী পুরো টাকার কতটা কী ভাবে খরচ হল সেই খোঁজ নেবেন, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এ দিন রাজ্যের বাজেট বরাদ্দেই আটকে রইলেন তিনি। সেই টাকা খরচের উপর ভিত্তি করেই প্রশংসা এবং তিরস্কার করলেন বিভিন্ন দফতরকে। যদিও সেই হিসেবেও বিস্তর জল মেশানো বলে অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের অন্দরেই।
শুধু তা-ই নয়, এ দিন প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠকে রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি বলে খবর। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত তিন বছরে বড় কোনও লগ্নির মুখ দেখেনি রাজ্য। বিভিন্ন জেলায় সরকারের শিল্প পার্কগুলিতে যে কয়েক’শো একর ফাঁকা জমি পড়ে রয়েছে। ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকঢোল পিটিয়ে যে জমি ব্যাঙ্ক তৈরি করেছে ভূমি সংস্কার দফতর, সেখান থেকে জমি নিতে উৎসাহী নন লগ্নিকারীরা। নতুন শিল্প নেই বলে কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। উল্টে একাধিক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যার বড় উদাহরণ জেসপ এবং হিন্দমোটর। যদিও এহেন মুখ থুবড়ে পড়া শিল্প পরিস্থিতিতেও কাজ ‘ভাল’ হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর বাহবা আদায় করে নিয়েছে শিল্প দফতর।
বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পাঁচ মাস পর সমস্ত দফতরের কাজের পর্যালোচনা করলাম। সবাই ভাল কাজ করেছে। কিছু ছোট ছোট ‘গ্যাপ’ থেকে গিয়েছিল। সেগুলো আলোচনা করে নিলাম।”
কিন্তু তাঁর পর্যালোচনার বাস্তবতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের অন্দরে। কেন? প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের মতে, সামাজিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিই সবচেয়ে বড় মাপকাঠি। অথচ এ রাজ্যে বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি বলে সরকারি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে। যেমন, গত আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় অনুদান হিসাবে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল রাজ্যের। কিন্তু সময়ে খরচ করতে না-পারায় বছর শেষে অনুদান প্রাপ্তির পরিমাণ কমে হয় ১৬ হাজার কোটি। অর্থ দফতরের অবশ্য অভিযোগ, প্রতিশ্রুতিমতো অনুদানের পুরো টাকা দেয়নি কেন্দ্র। কিন্তু কেন্দ্রীয় অনুদানের টাকা কী ভাবে কতটা খরচ হল, তার খোঁজ না নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পর্যালোচনার মূল কাজটাই করলেন না বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের বড় অংশ। অনেকের মতে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা পুরোপুরি খরচ হয়নি জেনেই এ নিয়ে কোনও আলোচনায় যাননি মুখ্যমন্ত্রী।
শুধু কেন্দ্রের টাকা খরচা করতে না-পারাই নয়, উন্নয়নের জন্য বাজার ও ঋণদানকারী সংস্থাগুলির কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকার বেশির ভাগটাই সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে ব্যয় হয়েছে বলে অভিযোগ। সে ব্যাপারেও কোনও আলোচনা করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিনের বৈঠকে রাজ্যের পরিকল্পনা বাজেটের টাকা খরচের হিসাব দেখে যে রিপোর্ট কার্ড তৈরি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতেও ধোঁয়াশা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেক সরকারি কর্তা। কী রকম? রাজ্য অর্থ দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, বাজেটের পরিকল্পনা খাতে বিভিন্ন দফতরের জন্য যা বরাদ্দ থাকে, সেই টাকা অর্থ দফতর থেকে ব্যাঙ্ক বা ট্রেজারি মারফত সংশ্লিষ্ট দফতরে চলে যাওয়া মানেই খাতায়-কলমে তা খরচ হয়ে যাওয়া। কিন্তু দফতরগুলি বাস্তবে সেই খরচ করছে কি না, সেই টাকায় প্রকৃত উন্নয়নের কাজ হল কি না, তার নজরদারি হয়নি পর্যালোচনা বৈঠকে!
প্রশ্ন হল, দফতরগুলি টাকা হাতে পেয়ে কী করছে? উদাহরণ দিয়ে রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দফতরের সচিব বলেন, “অর্থ দফতর থেকে আসা টাকা অনেক ক্ষেত্রেই খরচ না করে দফতরের কোনও-না-কোনও পার্সোনাল লেজার (পিএল) অ্যাকাউন্টে ফেলে রাখা হচ্ছে।” এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে ‘অসাধারণ’ (আউটস্ট্যান্ডিং) কাজের শংসাপত্র পাওয়া একটি দফতরের মন্ত্রী হাসতে হাসতেই বলেন, “আমার গুড় লাগে না, শুধু জল দিয়েই বাজিমাত! উন্নয়নের টাকার খরচ কী ভাবে দেখাতে হয়, সে ব্যাপারে আমার অফিসাররা বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন!”
সরকারি সূত্রের খবর, এ ভাবে শুধু জল দিয়েই বহু দফতর মুখ্যমন্ত্রীর সার্টিফিকেট আদায় করেছে। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, সেচ, সংখ্যালঘু উন্নয়ন, পূর্ত, সমবায়, অর্থ ইত্যাদি দফতর মুখ্যমন্ত্রীর বিচারে ‘অসাধারণ’ তকমা পেয়েছে। ‘খুব খারাপ’ নম্বর পেয়েছে পরিবেশ, জনশিক্ষা প্রসার, আইন ও বিচার, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ইত্যাদি দফতর। এ ছাড়া, অনেক দফতরকে ‘খুব ভাল’ বা ‘ভাল’ তালিকাভুক্ত করেছেন মমতা।
একই ভাবে জেলাগুলির র্যাঙ্কিং করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কন্যাশ্রী, গীতাঞ্জলি, নিজ ভূমি-নিজ গৃহ, ১০০ দিনের কাজ, সংখ্যালঘুদের বৃত্তি প্রদান এবং শিশু পুষ্টি সংক্রান্ত প্রকল্পে কাজের ভিত্তিতে প্রথম হয়েছে নদিয়া। সেখানকার জেলাশাসক পারভেজ বি সেলিমকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “তুমি এ বারও প্রথম হয়েছ। বাকিরা তো তোমাকে অনুসরণ করতে পারে।” নদিয়ার পরেই রয়েছে হুগলি, পুরুলিয়া বীরভূম ও বর্ধমান। মার্কশিটে সবার শেষে থাকা দুই জেলা হল উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর। মমতা উত্তর দিনাজপুরের জেলাশাসক স্মিতা পাণ্ডেকে খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য বকাবকি করেন। যদিও তালিকায় সবার শেষে থাকা দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলাশাসক তাপস চৌধুরীকে কার্যত কিছুই বলেননি।