কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের বয়স ছ’মাস পেরোলেও এখনও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এক বার দেখা করার সময় হয়নি তাঁর। নিজের মন্ত্রীদের উপরেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এ বার কেন্দ্রের ডাকে রাজ্যের আমলাদের দিল্লি যাওয়ার ক্ষেত্রে লিখিত ভাবেই রাশ টানলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বুধবার মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র যে নির্দেশিকা জারি করেছেন তার মূল কথা, এখন থেকে সচিব বা তার উপরের স্তরের অফিসারদের দিল্লি বা দেশের অন্যত্র কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকা বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে। সচিব পর্যায়ের নীচের অফিসারদের ক্ষেত্রে সফরের আগে অনুমতি নিতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের। এখানেই শেষ নয়, গত ছ’মাসে যে যে অফিসার দিল্লি বা অন্য রাজ্যে সরকারি বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা এবং সেই সব সফরের জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে তার বিশদ বিবরণও আলাদা ভাবে তলব করা হয়েছে। সফরের আগে অনুমতি নিতে বলার কারণ হিসেবে নির্দেশিকায় লেখা হয়েছে, ঘন ঘন সফরের ফলে এক দিকে যেমন খরচ বাড়ছে, তেমনি সিনিয়র অফিসারদের অনুপস্থিতিতে কাজেরও ক্ষতি হচ্ছে।
মুখ্যসচিবের জারি করা এ হেন নির্দেশিকা দেখার পরেই প্রবল উষ্মা তৈরি হয়েছে আমলা মহলে। তাঁদের অনেকেই বলছেন, রাজনীতির রেষারেষি থেকেই এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিকে জুড়ে ফেলা যে উচিত নয়, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সে কথা বলে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী। মমতা সেই পথে তো হাঁটছেনই না। উল্টে প্রতি দিন সম্পর্ক তিক্ত করছেন কেন্দ্রের সঙ্গে। সারদা-খাগড়াগড় নিয়ে যত চাপ বাড়ছে, ততই তিনি খড়্গহস্ত হচ্ছেন দিল্লির উপরে। এ দিনের নির্দেশিকা তারই ফল বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্যের এক বর্ষীয়ান আমলার কথায়, “রাজ্যের উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার গোটা মন্ত্রিসভাকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বসিয়ে দিয়েছেন। আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির থেকে নিজেকে তো দূরে রেখেছেনই। এ বার অফিসারদের পায়েও বেড়ি পরিয়ে দিলেন।”
মুখ্যসচিব তাঁর নির্দেশিকায় যেমন খরচ কমানোর কথা বলেছেন, তেমনি ওই আদেশনামার সঙ্গে অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর সই করা যে প্রোফর্মা জুড়ে দেওয়া হয়েছে তাতে গত ১ জুন থেকে সব অফিসারের দিল্লি যাত্রার হিসেব চাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন পদের কোন অফিসার কবে কবে দিল্লি গিয়েছেন ও সে বাবদ কত খরচ হয়েছে, তার সবিস্তার হিসেব জরুরি ভিত্তিতে জানাতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে।
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, কোনও দফতরের সচিব বা তাঁর চেয়ে উঁচু পদমর্যাদার কোনও অফিসার রাজ্যের বাইরে গেলে মুখ্যসচিবকে জানিয়ে যান। মুখ্যসচিবের কাছ থেকেই সে কথা জেনে যান মুখ্যমন্ত্রী। আর সচিবের থেকে নিচু পর্যায়ের অফিসারদের সফরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি নিলেই চলে। কিন্তু এখন থেকে পুরো বিষয়টাই মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যাবে। আর অনেক সফরের ক্ষেত্রেই তাঁর অনুমোদন মিলবে না, এমনটাই আশঙ্কা রাজ্য সরকারি অফিসারদের।
প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকে বলছেন, এই নির্দেশিকা এক অর্থে তো মুখ্যসচিব বা মন্ত্রীদের প্রতিও মুখ্যমন্ত্রীর অনাস্থার নজির। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী চাইলে মুখ্যসচিব বা মন্ত্রীদেরই অফিসারদের সফরে রাশ টানার কথা বলতে পারতেন। তা না করে, পুরোটাই নিজের এক্তিয়ারে নিয়ে এলেন।এক সচিবের কটাক্ষ, “আগের আমলে শুনতাম সরকার মহাকরণ থেকে নয়, চলবে তৃণমূল স্তর থেকে। এখন তো দেখছি সরকার নবান্ন-ও নয়, চলছে শুধু চোদ্দোতলা থেকে।”
রাজ্যের অফিসাররা কি অকাজেই ঘনঘন দিল্লি ছোটেন? নবান্ন সূত্র বলছে, কেন্দ্রের অজস্র প্রকল্প চলে রাজ্যে। পঞ্চায়েত দফতরের অধীনেই রয়েছে অন্তত ৩০টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প। একই ভাবে নগরোন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, নারী ও শিশুশিক্ষা, বন ও পরিবেশ, সড়ক যোগাযোগের মতো একাধিক দফতরের অধীনে কেন্দ্রের বহু প্রকল্প রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যে জঙ্গলমহলের উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করেন, তার সিংহভাগ অর্থ আসে দিল্লি থেকে। আবার, রেশন ব্যবস্থা চালু রাখার প্রায় পুরো টাকাটাও কেন্দ্রই দেয়।
এই সব টাকা যাতে নিয়মিত আসে তার তদ্বির করতে প্রায়ই দিল্লি ছুটতে হয় অফিসারদের। এ দিন রাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নিয়ম মেনে রাজ্যে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আসার কথা। কিন্তু মন্ত্রী এবং অফিসারদের ব্যক্তিগত চেষ্টা ছাড়া তা অনেক সময়ই হয় না। বাড়তি বরাদ্দ আদায়ের ক্ষেত্রে এই চেষ্টার গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত, লোকসভা ভোটের পর টাউন হলে মন্ত্রী-সচিবদের এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীই বলেছিলেন, কেন্দ্রের নতুন সরকারের থেকে প্রাপ্য আদায়ে অফিসারদের দরবার করতে হবে। ফলে বহু দফতরই অফিসারদের দিল্লি পাঠাতে শুরু করে। পঞ্চায়েত দফতরের এক কর্তার কথায়, “রাজ্যের জন্য টাকা আনতে গত ছ’মাসে বেশ কয়েক বার দিল্লি গিয়েছি। এখন তো দেখছি তার জন্য শূলে চড়ানো হবে! আর দিল্লিমুখো হব না। তাতে টাকা আসুক আর না-ই আসুক।”
দিল্লি যাওয়া শুধু টাকা আনতে নয়। সুপ্রিম কোর্টে চলা অজস্র মামলার দেখভালও রয়েছে। নয়া নির্দেশের কথা শুনে নবান্নের এক অফিসারের মন্তব্য, “ভালই হয়েছে। ছেলে-বউ ফেলে কে-ই বা বারবার দিল্লি যেতে চায়? এখন থেকে অন্তত অনুব্রত-আরাবুলকে বাঁচাতে বা সারদা মামলা ঠেকাতে আর দিল্লি যেতে হবে না।”
এই নজরদারির কারণ হিসেবে খরচ বৃদ্ধির যে কথা মুখ্যসচিবের নির্দেশনামায় রয়েছে, তার সঙ্গেও একমত নন নবান্নের অফিসারেরা। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি খরচ কমাতে সাধারণত বিদেশ ভ্রমণ, পাঁচতারা হোটেলে কনফারেন্স-সেমিনার, গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দিল্লিতে বৈঠকের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি কার্যত নজিরবিহীন।
তা ছাড়া, মুখে টাকা নেই, টাকা নেই বলে শোরগোল তুললেও কার্যক্ষেত্রে যে ভাবে হাতি গলে যাচ্ছে তা নিয়েও উষ্মা অফিসার মহলে। এক সরকারি কর্তার কথায়, “মেলা-খেলা-হরেক পুরস্কার বিলি করতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তাতে তো রাজ্যের কোনও উপকার হচ্ছে না। যত কোপ আমাদের দিল্লি সফরে!” গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ করে ৭০ বার জেলা সফর করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। লগ্নি টানার নামে ৫০ জনকে নিয়ে সিঙ্গাপুর ঘুরে এসেছেন। এ সব সফরের থেকে তাঁরা দিল্লি গেলে রাজ্যের অনেক বেশি উপকার হয় বলেই ওই কর্তার দাবি। তা ছাড়া, খরচের দোহাই দিলেও মুখ্যমন্ত্রীর সচিব গৌতম সান্যাল-সহ কলকাতায় কর্মরত একাধিক অফিসার যাতে সরকারি খরচে যখন-তখন দিল্লি যেতে পারেন, তাই তাঁদের অতিরিক্ত রেসিডেন্ট কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে বলে প্রশাসনের একাংশের অভিযোগ।
এ হেন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আনাতে সচিব থেকে মাঝারি স্তরের অফিসাররা এত দিন যে বাড়তি চেষ্টা চালাতেন তা আর দেখা যাবে না বলে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন বহু আমলা। তা হলে নয়া নির্দেশিকার জেরে কি আদতে রাজ্যেরই ক্ষতি হবে না? এর উত্তর জানতে মুখ্যসচিবকে ফোন করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস করেও জবাব মেলেনি।
রাজ্যের আমলাদের কেউ কেউ অবশ্য সরকারি নির্দেশনামার পিছনে অন্য কারণেরও গন্ধ পাচ্ছেন। এখন রাজ্যের কোটায় আইএএস অফিসারের পদ রয়েছে ৩৫৯টি। বাস্তবে রয়েছেন আড়াইশো জন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই রাজ্য সরকারের কাজকর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দিল্লি যেতে আগ্রহী। তাদের মতে, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো মনে করছেন, বদলির দরবার করতেই ঘনঘন দিল্লি যাচ্ছেন আইএএস অফিসারেরা।
কিন্তু নিচুতলার অফিসারদের ক্ষেত্রে সেই যুক্তি খাটে না। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, সারদা থেকে বর্ধমান নানা বিষয়ে ব্যাকফুটে থাকা মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন, তাঁর অফিসাররা দিল্লি গিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ খবর জানিয়ে আসছেন বা রাজ্য সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার করছেন। সেই কারণেই তিনি নিজে বাছাই করে অফিসারদের দিল্লি পাঠাতে চান।