মসরুর বাবা মেকাইল বিশ্বাস। ছবি: শৌভিক দে।
ছেলের জঙ্গি সংস্রবের খোঁজ মিলেছে গুঞ্জন শুনে তাঁকে মোবাইলে ফোন করেছিলেন বাবা। অবশ্য শুক্রবার রাতে বেঙ্গালুরুতে বসে ছেলে সেই ফোনের মাধ্যমে কৈখালিতে উদ্বেগে থাকা বাবা-মাকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন, তাঁর ই-মেল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে। এ সব নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।” কিন্তু শনিবার সকালেই চিত্রটা বিলকুল বদলে গেল। ছেলের মোবাইলে বাবা-মা বার বার ফোন করলেও শোনা গেল, সেটি ‘সুইচ্ড অফ্’। এর পর কৈখালির বিমাননগরের ওই বৃদ্ধ দম্পতি জানতে পারলেন, তাঁদের একমাত্র ছেলে মেহদি মসরুর বিশ্বাসকে জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওই খবর মেলার কিছু পরেই কয়েক জন প্রতিবেশীর সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে, তাঁদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ মেকাইল বিশ্বাস জানতে চাইছেন, ছেলেকে তিনি কী ভাবে বাঁচাবেন। সাবেক রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার তিনি। পরিবারের সদস্যেরা জানান, বেঙ্গালুরুতে ছেলের গ্রেফতারির খবর মেলার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মেহেদির মা মুমতাজ বিশ্বাস। আত্মীয়দের কাছে ওই বৃদ্ধা আক্ষেপ করে বলছেন, তিনি নিজে বেঙ্গালুরুতে এই ঘটনা ঘটত না। বেশ কয়েক মাস ছেলের কাছে থাকার পর স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় গত ২৫ নভেম্বর বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন তিনি।
জঙ্গি সন্দেহে বেঙ্গালুরুতে গ্রেফতার হওয়া মেহদির কলকাতার বাড়িতে শনিবার যেন স্বজন হারানোর বেদনা। বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়ে প্রতিবেশীদের জটলা।
বছর চব্বিশের ছেলের জঙ্গি সংস্রব থাকতে পারে, সে কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মেকাইল। তাঁর দাবি, “হয়তো পুলিশের কোথাও ভুল হয়েছে। নামের ভুল হতে পারে। আবার মেহদি তো নিজেই ওর ই মেল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। সেখান থেকেও কোনও সমস্যা হতে পারে।” বৃদ্ধ মেকাইলের কথায়, “আমি আর আমার স্ত্রী বেঙ্গালুরুতে ছেলের সঙ্গে টানা বেশ কয়েক মাস থেকেছি। ওর অফিসের কাজের ভয়ঙ্কর চাপ। এই ধরনের কাজকর্মে জড়িত থাকার মতো সময়ই ওর নেই।”
মেহদি যে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের সঙ্গে কোনও ভাবে জড়িত থাকতে পারেন, সে কথা প্রতিবেশীরাও বিশ্বাস করছেন না। তাঁদেরই এক জন, আবেদা বিবির কথায়, “মেহদি কারও সঙ্গে পাড়ায় তেমন মেলামেশা করত না। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়েই থাকত। সেই ছেলে জঙ্গি? হতেই পারে না।” একই মত আর এক প্রতিবেশী মহম্মদ হাবিবের, “মেহেদিকে ওর ছোটবেলা থেকে চিনি। ঝগড়া-বিবাদেই কখনও পারতপক্ষে জড়ায়নি। আর সে কি না করবে দেশবিরোধী কাজ?”
মেহদির বাড়ির লোকজন জানান, ২০১১ সালে ওই যুবক একটি বেসরকারি কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাশ করার পর সেখানেই ‘ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ’-এর মাধ্যমে বেঙ্গালুরুর ওই বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি পান। ন’মাস প্রশিক্ষণ শেষে ২০১২-র মাঝামাঝি বেঙ্গালুরুতে কাজে যোগ দেন ওই যুবক। সেখানে জালহালালিতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন মেধাবী ওই ছাত্র। তিনি ‘ক্যাট’ পরীক্ষার জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বেশির ভাগ সময়ে ছেলের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন মা মুমতাজ।
কৈখালির বিমাননগরে নিজেদের দোতলা বাড়িতে প্রায় ১৪ বছর ধরে রয়েছেন মেকাইল বিশ্বাস ও তাঁর পরিবার। তাঁদের আদি নিবাস উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ায়। তারও আগে চাকরি সূত্রে স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং এক মাত্র ছেলে মেহদিকে নিয়ে কোলাঘাটে থাকতেন তিনি। ২০০০ সালে কলকাতায় ফিরে এসে বিমাননগরে ওই দোতালা বাড়িটি তৈরি করেন।
মেকাইল বিশ্বাস এক সময়ে ওই তল্লাটে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। এখন সে সব ছেড়ে দিয়েছেন। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে মেহদিই ছোট। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগেই দুই যমজ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা থাকেন কলকাতাতেই। এ দিন সকালে ভাইয়ের গ্রেফতারির খবর পেয়ে ছোট মেয়ে বাপের বাড়িতে আসেন।
মেহেদির খুড়তুতো ভাই আবদুল মান্নানের দাবি, বরাবরই মেহদি ভাল ছাত্র। কোলঘাট থেকে কলকাতায় এসে বাগুইআটির একটি বেসরকারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন মেহদি। মাধ্যমিকে আশি শতাংশের বেশি নম্বর নিয়ে পাশ করার পর বিমানবন্দর এলাকার একটি কেন্দ্রীয় স্কুলে ভর্তি হন। উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি পানিহাটির একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।
এ দিন বাড়িতে বসে মেকাইল বিশ্বাস জানান, “স্কুলের পরীক্ষায় ছেলে সব সময়ে এক থেকে তিনের মধ্যে থাকত। পড়াশোনা ছাড়া ওর অন্য জগৎ ছিল না। আর সেই ছেলেকে জঙ্গি বলে কী করে মেনে নেব? পুলিশের নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।” বেঙ্গালুরু পুলিশ মেহদির গ্রেফতারির বিষয়ে তাঁদের কিছু জানায়নি। এ দিন বিকেল পর্যন্ত মেকাইল কোনও ভাবেই বেঙ্গালুরু পুলিশের যোগাযোগ করে উঠতে পারেননি। এ দিন বেঙ্গালুরুতে থাকা মেহদির অন্য বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযাগ করার চেষ্টা করেন বাড়ির লোকজন। কিন্তু পারেননি। আগামী দু’-এক দিনের মধ্যে তাঁরা বেঙ্গালুরুতে যাবেন বলে মেকাইলের বাড়ির লোকজন জানিয়েছেন।