বাইরে আক্রমণ। তলে তলে নৈকট্য! বিজেপি-র বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সম্পর্কে এটাই কি এখন কংগ্রেসের নীতি? বিধানসভায় মঙ্গলবারের ঘটনাপ্রবাহ এমন প্রশ্নকেই আরও জোরালো করে দিল!
বামেদের ছাপিয়ে বিধানসভার মধ্যে প্রধান বিরোধী পক্ষ হয়ে ওঠার জন্য দলীয় বিধায়কদের আরও আক্রমণাত্মক হওয়ার পরামর্শ দিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। আবার একই সঙ্গে দলের হাইকম্যান্ড যে অদূর ভবিষ্যতে ফের তৃণমূলের হাত ধরতে বলতে পারে, সেই সম্ভাবনার কথাও বিধায়কদের শুনিয়ে রাখলেন তিনি। ঘটনাচক্রে, তার অব্যবহিত পরেই কংগ্রেস বিধায়কদের রণং দেহি মূর্তি দেখল বিধানসভা! অধীরেরই খাস তালুক বহরমপুরের কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীর সঙ্গে তৃণমূল বিধায়ক তথা পরিষদীয় সচিব অসীমা পাত্রের বচসায় উত্তপ্ত হল অধিবেশন।
বিধানসভার কক্ষে এ দিন মনোজ-অসীমা বচসার ঘটনার দু’রকম ব্যাখ্যা মিলছে। তৃণমূল শিবির মনে করছে, অধীর কড়া দাওয়াই দেওয়ার পরেই হাতে-কলমে তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন মনোজবাবু। আবার কংগ্রেসেরই একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, শাসক দলের সঙ্গে নৈকট্য আড়াল করতে চেয়েই এমন ঘটনা। ওই সূত্রের বক্তব্য, প্রদেশ সভাপতি এ দিন বিধায়কদের বৈঠকে বুঝিয়েছেন, অদূর ভবিষ্যতে ফের তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে হতে পারে বলে হাইকম্যান্ডের মনোভাব দেখে তাঁর ধারণা হয়েছে। তৃণমূলের এখন ৩৪ জন লোকসভা সাংসদ। বিজেপি-কে ঠেকাতে সব সমীকরণই সম্ভব। প্রকাশ্যে অবশ্য অধীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনও নৈকট্যের বার্তা দেননি। পরিষদীয় বৈঠকের পরে এ দিন তিনি বলেছেন, “কংগ্রেস একাই আছে, একাই লড়বে। কারও সঙ্গে কক্ষ সমন্বয় বা মেলামেশার প্রশ্ন নেই।”
লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের রাজ্যওয়াড়ি ময়না তদন্তের জন্য এ কে অ্যান্টনির নেতৃত্বে গঠিত কংগ্রেসের সর্বভারতীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে সোমবারই দিল্লি গিয়েছিলেন অধীর, মানস ভুঁইয়ার মতো এ রাজ্যের প্রথম সারির কংগ্রেস নেতারা। মঙ্গলবার বিধানসভায় এসে কংগ্রেস বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অধীর। জনস্বার্থের বিভিন্ন বিষয় চিহ্নিত করে, কোনও ঘটনা ঘটলে দলীয় বিধায়কদের ঘটনাস্থলে ঘুরে বিধানসভায় মুখর হতে বলেন অধীর।
প্রদেশ সভাপতির এই বৈঠকের পরেই অধিবেশনের দ্বিতীয়ার্ধে ছিল ক্ষুদ্র শিল্প দফতরের বাজেট-বিতর্ক। জোট-সরকারের জমানায় কিছু দিন ওই দফতরেরই প্রতিমন্ত্রী থাকা মনোজবাবু ছিলেন কিছু দিন। দফতরের টাকা খরচের ব্যর্থতার অভিযোগ তোলেন। মনোজবাবু সুর চড়ানো মাত্রই শাসক বেঞ্চ থেকে নানা মন্তব্য করছিলেন অসীমা। “ভূতেরও ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু এই দফতরের কোনও ভবিষ্যৎ নেই!” মনোজবাবু এমন কথা বলামাত্রই অসীমার সঙ্গে তাঁর বিতণ্ডা বাধে। পরে তিনি ফের বক্তৃতা শুরু করতেই ফের সেই একই ঘটনা! মনোজবাবুকে এক সময় দেখা যায়, ওয়েলে নেমে এসে স্পিকারের উদ্দেশে বলছেন, তাঁর বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ স্পিকার কেন কিছু করছেন না? বচসা চলতে চলতেই কংগ্রেস বিধায়কেরা ওয়াক আউট করে বাইরে গিয়ে ধর্নায় বসে পড়েন।
ভিতরে তখন বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন, মনোজবাবু যে ভাবে আস্তিন গুটিয়ে মারমুখী হয়ে স্পিকারের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন, তার জন্য ওই বিধায়কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “কোনও ব্যবস্থা না হলে কেউ কেউ ভাববেন, বিধানসভা বোধহয় দুর্বল হয়ে গিয়েছে! প্রস্তাব আকারে বিষয়টি আনা হলে আমি ব্যবস্থা নিতে পারি।” বাইরে যা শুনে মনোজবাবুর প্রতিক্রিয়া ছিল, “নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়েছিলাম। যা শাস্তি হবে, মাথা পেতে নেব!” সন্ধ্যায় অবশ্য তৃণমূলের পরিষদীয় নেতৃত্বই ঠিক করেন, মনোজবাবুর শাস্তি চেয়ে কোনও প্রস্তাব আনা হবে না। কারণ, তাতে কংগ্রেস আবার হাতিয়ার পাবে। যদিও এই পিছিয়ে আসাতেও নৈকট্যের গন্ধই পাচ্ছেন কেউ কেউ!