ওঠার মতো পড়ার মূলেও বিষ্ণুপুর

সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ যে দরজা দিয়ে, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার শিকড়ও সেই একই জায়গায়! বিষ্ণুপুর পশ্চিম। বিধানসভা কেন্দ্রটা এখন আর নেই। সীমানা পুনর্বিন্যাসে অবলুপ্ত। কিন্তু ওই সাবেক আসনটিই মদন মিত্রের রাজনৈতিক জীবনের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে তৃণমূল তো বটেই অন্য দলের নেতাদের একাংশও স্বীকার করে নেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৫
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ যে দরজা দিয়ে, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার শিকড়ও সেই একই জায়গায়!

Advertisement

বিষ্ণুপুর পশ্চিম। বিধানসভা কেন্দ্রটা এখন আর নেই। সীমানা পুনর্বিন্যাসে অবলুপ্ত। কিন্তু ওই সাবেক আসনটিই মদন মিত্রের রাজনৈতিক জীবনের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে তৃণমূল তো বটেই অন্য দলের নেতাদের একাংশও স্বীকার করে নেন। ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে হওয়া ওই বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে প্রায় ৩০ হাজার ভোটে জিতে প্রথম বার বিধায়ক হন মদন। কিন্তু শুক্রবার বিকেল চারটের পর থেকে রাজনীতির কারবারিদের একাংশ বলতে শুরু করেছেন, ওই উপনির্বাচনে না জিতলে বোধ হয়

এ দিনটা হয়তো দেখতে হতো না মদনকে। কারণ, ওই বিষ্ণুপুর পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক হওয়ার সুবাদেই মদন প্রথম সারদা সংস্থা তথা সুদীপ্ত সেনের সংস্পর্শে আসেন বলে সিবিআই জেনেছে।

Advertisement

ওই একই কেন্দ্রে ২০০৬-এর বিধানসভা ভোটে সিপিএমের কাছে হেরে যান মদন। তার পরেও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু মদন ছাড়া অন্য কাউকে প্রার্থী করার কথা ভাবেননি ২০০৯-এর ওই গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচনে। গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বইতে শুরু করা পরিবর্তনের হাওয়া আরও গতি পেয়েছে কি না, তার মস্ত বড় পরীক্ষা ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক সাদামাঠা গঞ্জের ওই অকাল ভোট। যেখানে কংগ্রেস প্রথমে প্রার্থী দিয়েও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেয়। সেটাই ছিল ২০০৯-এর লোকসভা ও ২০১১-র বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট তথা আসন সমঝোতার এক রকম শুরুর শুরু।

বরাবরই তৃণমূল নেত্রীর ‘খাস লোকদের অন্যতম’ হিসেবে পরিচিত মদন কংগ্রেসি রাজনীতি শুরু করেন প্রায় মমতার সঙ্গেই। পরে মমতা যখন কংগ্রেসে থেকেই ক্রমশ জননেত্রী হয়ে উঠতে শুরু করেছেন, তাঁর বিভিন্ন কর্মসূচির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মদন। এক বার মেট্রো চ্যানেলে ‘রক্ত দিয়ে দেওয়াল লিখন’-এর কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন মমতা। লোকজন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মদন বড় ভূমিকা নেন। আবার ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই রাজ্যের তৎকালীন যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতার ডাকে মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১৩ জন। পুলিশের নথি বলে, প্রাথমিক ভাবে তাদের তাড়া খেয়ে জনতা ছত্রভঙ্গও হয়ে গিয়েছিল এবং মনে করা হয়েছিল, কর্মসূচির সেখানেই ইতি। কিন্তু হঠাৎ বিশাল এক মিছিল আসতে দেখে মদনই পুলিশি প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার ডাক দেন। তার পরেরটুকু ইতিহাস।

১। ই-রিকশা উদ্বোধনে পরিবহণমন্ত্রী। ২। মিলেনিয়াম পার্কের কাছে প্রমোদতরীর উদ্বোধনে।
৩। ব্রিগেডে ‘বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা’ বাজালেন মমতা। সঙ্গী মদন। ’৯২-এর নভেম্বরে।
৪। সারদার অনুষ্ঠানে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে।

ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে।

রাজনীতিতে মদন মিত্রের হাতেখড়ি ছাত্রজীবনে, আশুতোষ কলেজে পড়ার সময়ে। রাজনীতি করলেও কলেজে কিন্তু ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে তাঁর গুরু সে অর্থে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। জরুরি অবস্থার পর প্রিয়রঞ্জন যখন ইন্দিরা গাঁধীর হাত ছেড়ে কংগ্রেস(স)-এ যোগ দেন, মদনও যান তাঁদের সঙ্গে। পরে প্রিয়রঞ্জনদের অনুসরণ করেই আবার ফিরে আসেন কংগ্রেসে। তখনও জন্ম হয়নি তৃণমূলের।

মদন মূলত ছিলেন (এবং এখনও কিছুটা আছেন) দক্ষিণ কলকাতা, আরও ঠিক করে বললে ভবানীপুরের নেতা। কারণ, তাঁর রাজনীতির বৃত্তটাই ভবানীপুর, যদুবাবুর বাজার, হরিশ মুখার্জি রোড, এসএসকেএম হাসপাতাল এই তল্লাট ঘিরে। সেখানেই মদনের সংগঠনের মূল ভিত্তি। ভবানীপুরে আশুতোষ মুখার্জি রোডের উপর একটি মিষ্টির দোকানের (এখন বন্ধ) দোতলায় ছিল তাঁর আদি কার্যালয়। কংগ্রেসের ওই দলীয় অফিসে প্রিয়রঞ্জন তো বটেই, সৌগত রায় ও কুমুদ ভট্টাচার্যরাও বসতেন। কালেদিনে ওই অফিস কার্যত মদনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এবং তত দিনে কংগ্রেসের যুবনেতা হিসেবে মদন ক্রমশ উঠে আসছেন।

মদনের কদর বাড়ার মূল কারণ, তাঁর এক ডাকে অল্প সময়ে প্রচুর যুবক জড়ো হয়ে যান। সিপিএমে যে ক্ষমতা ছিল সুভাষ চক্রবর্তীর, যদিও আরও বড় পরিসরে। আসলে মদন ও তাঁর অনুগামীরা বছরভর নানাবিধ সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, রক্তদান ও চক্ষুদান শিবিরের আয়োজন, প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দান এই সবই মদনের জনসংযোগের হাতিয়ার। মন্ত্রী হওয়ার পরেও কিন্তু এ সবে ভাটা পড়েনি।

মদন একটা সময়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার উচ্চপদে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে বিমাকর্মীদের ইউনিয়নের নেতাও হন। পরে প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেনস ইউনিয়ন, মেট্রো রেলের কর্মীদের ইউনিয়ন গড়ার পিছনে মদনের বড় ভূমিকা রয়েছে। আর যে সংস্থার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে এ দিন মদন গ্রেফতার হলেন, সেই সারদার কর্মী ইউনিয়নেরও সভাপতি ছিলেন তিনি।

রাজ্যে কংগ্রেসের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়ে মমতা যখন নিজেই নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করলেন, সেই সময়ে গোড়া থেকেই তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন মদনকে। কংগ্রেস রাজনীতিতে প্রায় একই সঙ্গে উঠে আসার সুবাদে মমতার ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে থেকে গিয়েছেন মদন। দু’জনের সম্পর্কে জোয়ার-ভাটা এসেছে, কিন্তু মমতা কখনও বিচ্ছিন্ন করে দেননি মদনকে। বরং, অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে মদনের উপর আস্থা রেখেছেন। বিষ্ণুপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের মতো কঠিন পরীক্ষায় যেমনটি দেখা গিয়েছিল।

তারও পাঁচ বছর আগে, ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে মমতা প্রথমে মদনকেই প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পরে রাজনৈতিক কারণে তাঁকে ওখান থেকে প্রত্যাহার করেন মমতা, প্রার্থী করেন আরএসপি থেকে সদ্য তৃণমূলে আসা শিশ মহম্মদকে। প্রসঙ্গত, সে বার জঙ্গিপুর থেকে জিতেই প্রথম বার লোকসভায় যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১১-র পালাবদলের পর মমতার মন্ত্রিসভায় গোড়া থেকেই সদস্য মদন। ক্রমেই মদনের গুরুত্ব মন্ত্রিসভায় বেড়েছে।

তবে এই ধরনের আস্থা রাখলেও মদন মিত্রের ব্যক্তিগত জীবনযাপন সব সময়ে যে মমতা পছন্দ করেছেন, তা আদপেই নয়। তৃণমূল সূত্রের খবর, মদনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনাপ্রবাহে মমতা বিড়ম্বনায় পড়েছেন এবং তারই ফলস্বরূপ নেত্রীর বিরাগভাজন হয়েছেন মদন। ২০১৩-র মার্চে আইনজীবী পিয়ালি মুখোপাধ্যায়ের ঝুলন্ত দেহ রাজারহাটের একটি আবাসন থেকে উদ্ধার হয়। পিয়ালি মদনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে পুলিশ জানতে পারে, নানা রকম মুখরোচক কথাও তখন বাজারে ছড়িয়েছিল। মমতা নিজে বিড়ম্বনায় পড়ার পর কখনও প্রকাশ্যে, কখনও আড়ালে মদনকে প্রচণ্ড তিরস্কার করেছেন। একই অনুষ্ঠানে গিয়েও তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছেন লক্ষ্যণীয় ভাবে। এমনকী, একটা সময়ে মমতা তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে ছেঁটে ফেলবেন, এমন গুঞ্জনও ভাল রকম ছড়িয়েছিল। কিন্তু সে সব হয়নি। তবে দীর্ঘদিন ধরে এসএসকেএম হাসপাতালে কর্মী ইউনিয়ন ও আরও নানা বিষয় সামলে আসা মদনকে কিন্তু গত কিছু দিন ধরে তাঁর ‘খাস তালুক’ থেকেই খানিকটা সরিয়ে রেখেছিলেন নেত্রী। সেখানে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে মমতা যে দিন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করেছিলেন, ববি-ই (ফিরহাদ হাকিম) পিজি-টা দেখে তার মধ্যে বিশেষ অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন রাজনীতির লোকজন। কারণ সারদা-তদন্ত তখন অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাড়ি। তবু মদন ছিলেন না পিজি-র সেই অনুষ্ঠানে। তাঁর বিব্রত অনুগামীরা সে সময় জানিয়েছিলেন, চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে ওটা দাদার যোগাসন করার সময়। ‘দিদি’কে আগেই জানিয়েই রেখেছিলেন তিনি। এর পরেও অবশ্য পিজি-তে দেখা গিয়েছে মদনকে। সেটা রোগী হিসেবে।

মদনের ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, ব্যক্তিগত জীবনযাপনে তিনি রসেবশে থাকতে ভালবাসেন। খেলোয়াড় থেকে গায়ক, নায়ক থেকে সুন্দরী অভিনেত্রী মদনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে এঁদের অনেকেরই বিচরণ। পরিচিতির গণ্ডিটা ব্যাপক বলেই তাঁকে নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন শোনা যায়। তার কত শতাংশ ঠিক এবং কতটা কল্পনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মদন কখনও সে সব গায়ে মাখেননি বা ওই সব প্রসঙ্গ ওঠায় কূপিত হননি। বরং, তিনি এই সব এক রকম উপভোগই করেছেন। তা ছাড়া, তাঁর অতি বড় শত্রুও স্বীকার করে নেন, কেউ বিপদে পড়েছেন শুনলে বা জানতে পারলে, মদন সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিপন্নের রাজনৈতিক পরিচিতির কথা সে সব ক্ষেত্রে মাথায় রাখেন না।

তৃণমূলের একাংশের খবর, রাজনীতির দায়ে এ ক’দিন প্রকাশ্যে খানিকটা দূরে দূরে রাখলেও মদনের ওই ‘ইউএসপি’-র কথা মাথায় রেখেই দলনেত্রী মমতা আজ সরবে পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোগীর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement