মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের বাড়িতে ফেরার পরে বাপিকে আদর মা সুলোচনাদেবীর। ছবি: বাপি মজুমদার।
একদিন আগে জামিন পেলেও, পদ্ধতিগত টানাপড়েন মিটিয়ে অবশেষে শনিবার বিকেলে মালদহ সংশোধনাগার থেকে বাড়ি ফিরলেন ফেসবুক কাণ্ডে ধৃত বাপি পাল। মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ফেসবুকে অশালীন মন্তব্য করে ধৃত বাপির জামিন মঞ্জুর হয় শুক্রবারেই।
আদালতের নির্দেশ সংশোধনাগারে পৌঁছতে সময় লাগায় মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের যুবক বাপি পালকে শুক্রবারের রাতটিও জেলেই কাটাতে হয়। শনিবার সকালে মালদহ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাড়ি ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পর মা সুলোচনা দেবীর চোখের জলে ভিজে যায় বাপির জামা। এ দিন বাপি এবং তাঁর বাবা মুকুলবাবু দু’জনেরই মন্তব্য ছিল, “আর তৃণমূলকে সমর্থন করব কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।”
বাড়িতে ঢোকার আগে হরিশ্চন্দ্রপুর রেল স্টেশনেই বাপির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর প্রায় শ’দেড়েক বন্ধু ও প্রতিবেশীরা। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তৃণমূল সমর্থক বলে পরিচিত। বাপির পরিবারও তৃণমূলের সমর্থক হিসেবেই পরিচিত। পরিবারের সদস্যদের দাবি, দলের সাধারণ কর্মীদের সিংহভাগ আগাগোড়া তাদের সঙ্গে থাকলেও, শাসক দলের শীর্ষ মহলের নির্দেশেই যাবতীয় ঘটনা ঘটেছে।
এ দিন বাড়ি ফেরার পর বাপিও নিজেকে তৃণমূল কর্মী বলেই দাবি করেছেন। দলীয় সূত্রেও জানা গিয়েছে, গত লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থীর জন্য কাজ করেছিলেন বাপি। এলাকার তৃণমূল কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, এখন যাঁরা বাপির বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁরা লোকসভা ভোটের সময়ে বিরোধী দলে ছিলেন। কেউ কেউ দলে থাকলেও, ভোট প্রচারে বুথ খরচের টাকা না পাওয়ার অভিযোগ তুলে দলনেত্রীর ছবি ছিঁড়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে বাপি পালের পাশে দাঁড়ানো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক তৃণমূল নেতা-কর্মীর দাবি,“দলে প্রকৃত কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। গত মঙ্গলবার রাতে বাপিকে গ্রেফতারের পরে বুধবার চাঁচল মহকুমা আদালতে তোলা হয়। যদিও সে দিন তৃণমূলের এক আইনজীবী নেতা দাবি করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করায় ধৃতের হয়ে কোনও আইনজীবী সওয়াল করবেন না। ঘটনাচক্রে সে দিন বাপি কোনও আইনজীবীকে নিজের পক্ষে পাননি। বিচারক বাপিকে জেল হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। এরপরে গত শুক্রবার আইনজীবীদের একাংশ বাপির সমর্থনে এ গিয়ে আসেন। জামিন যোগ্য ধারায় মামলা হওয়ায় বিচারক তনুময় কর্মকার বাপির জামিনের আবেদনও মঞ্জুর করেন।
এ দিন মালদহ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাপির প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, “এই কয়েকদিনে একটা অভিজ্ঞতা হল। এ রাজ্যের আইন সবার জন্য এক নয়। গরিব আর বড়লোকদের জন্য আইন আলাদা। সেজন্য তাপস পাল ক্ষমা চেয়েছেন বলে তাঁকে ছাড় দেওয়া হয়। আর আমি ও আমার পরিবারের লোকেরা ভুলের জন্য জনে জনে ক্ষমা চাইলেও পৃথক ফল মিলল।”
সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে কর্মচ্যুত হওয়ার পর এলাকার ক্লাবেই বেশি সময় কাটত বাপির। রেল স্টেশন সর্বজনীন পুজোর অন্যতম সক্রিয় সদস্যও ছিল সে। এ দিনই পঞ্চায়েত সমিতির তরফে ওই পুজোকে শারদ সন্মান দেওয়া হয়। বাপি ফিরবে জেনে ট্রফি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ক্লাবের সদস্যরা। বাপি পৌঁছাতেই তাঁকে সামনে রেখে উৎসব শুরু হয়ে যায়।
অশালীন মন্তব্য করা নিয়ে অবশ্য বাপি বলেন, “সিভিক পুলিশের কাজ হারানোর পর মনটা একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। তারপর সারদায় এতলোক নিঃস্ব হলেও মুখ্যমন্ত্রী সিবিআইয় তদন্তের বিরোধিতা করেছিলেন। একের পর এক ঘটনায় মন খারাপ হওয়ার পাশাপাশি রাগও হচ্ছিল। বর্ধমান কাণ্ডে একই ঘটনা দেখার পর আর নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। প্রচন্ড রাগ হওয়ায় ওই মন্তব্য করে ফেলি। তবে ওই মন্তব্য করা কখনওই ঠিক হয়নি।”
বৃহস্পতিবার মালদহ জেলে ছেলেকে দেখতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী মুকুলবাবু। এ দিন বিছানায় শুয়েই বলেন, “ছেলে ফিরেছে ভালো লাগছে। তৃণমূলের জন্য গোটা পরিবারকে ভুগতে হয়েছে। ভাবছি এরপরে আর দল করব কিনা। তবে দলের একাংশ ছেলের পাশে আগাগোড়া থেকেছে।”
বাপি ফেরায় বন্ধুদের পাশাপাশি খুশী প্রতিবেশীরাও। প্রতিবেশী কণিকা মণ্ডল, নারায়ণ দাস বলেন, “আগাগোড়া ওকে নিরীহ বলেই জানি। কি যে হয়ে গেল।” বন্ধু গৌতম মন্ডল, রমেশ ওঁড়াও, সুমিত সিংহরা বলেন, “পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ওকে বয়সের তুলনায় বড় বেশি সচেতন মনে হয়। তারই খেসারত দিতে হল ওকে।”