চোপড়ার সভা শেষ। আলিপুরদুয়ার যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারে উঠেও পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সিগন্যাল না মেলায় উড়তে পারেনি কপ্টার। বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতে হয় তাঁকে। আধঘণ্টা অপেক্ষার পরে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী সড়ক পথেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। গাড়িতে কিছু দূর এগিয়েও যান। তার পরেই অবশ্য হেলিকপ্টার ওড়ার অনুমতি মেলার খবর পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। ফের কপ্টারে রওনা হন। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
ভোটের লড়াইয়ে আবার অস্ত্র এইমস। শুক্রবার রায়গঞ্জের করণদিঘির জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শুধু রায়গঞ্জ নয় শিলিগুড়ি, ইটাহার, বালুরঘাট বা কালিয়াগঞ্জ, যে কোনও শহরে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হতে পারে। তবে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা চলবে না।
কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাশমুন্সি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বারবার অভিযোগ করেছেন, রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করেনি বলেই রায়গঞ্জে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এ দিন দীপাদেবীর নির্বাচনী কেন্দ্রে এসে মমতা কৌশলে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন। এক, তিনি ফের বললেন, “কৃষকদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে” জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। এ ভাবে কৃষকদের প্রতি তাঁর সহানুভূতির অবস্থানকে ফের স্পষ্ট করে দীপার অভিযোগের জবাব দিলেন। আর দুই, শিলিগুড়ি, ইটাহার, বালুরঘাট কিংবা কালিয়াগঞ্জেও এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হতে পারে, এ কথা বলে এই এলাকার মানুষদের আশা জাগিয়ে রাখলেন। এতে দীপার উপরে পাল্টা চাপ তৈরি হল। কারণ, এই এলাকাগুলিতে এইমসের দাবি উঠলে, কংগ্রেসের পক্ষে শুধু রায়গঞ্জের দাবিকে সামনে রেখে প্রচার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ দিন বক্তব্যে অবশ্য রায়গঞ্জের বিদায়ী সাংসদ দীপাদেবীর নাম একবারও উল্লেখ করেননি মুখ্যমন্ত্রী। এইমস প্রসঙ্গে দীপাদেবীকে আক্রমণের নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ভোটে জিতে শুধু বড় বড় কথা বললেই হয় না। ওঁর শুধু একটাই কথা, আমি নাকি এইমস করতে দিচ্ছি না। আরে আমি কে? ওটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়।” তারপরেই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “তুমি শিলিগুড়ি, ইটাহার, বালুরঘাট, কালিয়াগঞ্জ যেখানে পারবে এইমস করো। আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আমি কখনোই কৃষকদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করব না।” জমি অধিগ্রহণ বিরোধিতা প্রসঙ্গে সিঙ্গুর আন্দোলনের কথাও জনসভায় বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “কৃষকদের জমি রক্ষার স্বার্থেই আমি ২৬ দিন অনশন করেছি। তাই দয়া করে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে রাজনীতি করবেন না।”
দীপা দাশমুন্সি এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কথার কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তরজায় যাব না। অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে আমার এখানেই তফাত। যা বলার দলই বলবে।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহিত সেনগুপ্ত বলেন, “তৃণমূল সরকার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে হাসপাতালের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেনি, তা কারও অজানা নয়। নির্বাচনের সময়ে সেটা সরকারকে বিপাকে ফেলতে পারে বলেই এখন মুখ্যমন্ত্রী এ কথা বলছেন।”
এইমসের পরিবর্তে রায়গঞ্জে মাল্টি সুপার স্পেশালিটির হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকার নিয়েছে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “রায়গঞ্জ ও ইসলামপুরে দুটি মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে।” এ দিন মমতার মঞ্চে তৃণমূল প্রার্থী সত্যরঞ্জন দাশমুন্সিও উপস্থিত ছিলেন।
রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির উদ্যোগে ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৮২৩ কোটি টাকা বরাদ্দে রায়গঞ্জে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির ঘোষণা করে।
তার জন্য প্রায় ১০০ একর জমি প্রয়োজন বলে সে সময় জানানো হয়। হাসপাতাল তৈরির জন্য রাজ্য সরকারকে জমি ও পরিকাঠামো গড়ে দিতে হবে বলে সে সময়ে কেন্দ্র জানিয়েছিল। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে তৃণমূল সরকার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এগোতে দেয়নি বলে কংগ্রেসের অভিযোগ। দ্রুত জমি অধিগ্রহণ করে হাসপাতাল তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করার দাবিতে গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়েই আন্দোলন শুরু করেছিল কংগ্রেস।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে পানিশালা এলাকার চাষিরা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে স্বেচ্ছায় জমি দেওয়ার ইচ্ছের কথা লিখে নিয়ে মহাকরণ অভিযানও করেন। কয়েকমাস আগে দীপাদেবী জমি অধিগ্রহণের দাবিতে কলকাতায় আমরণ অনশন শুরু করলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ ও আশ্বাসে তিনি অনশন তুলে নেন বলে দলীয় সূত্রে জানানো হয়েছে।
এইমস নিয়ে অবশ্য দীপাকে চাপে রেখেছেন রায়গঞ্জের সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমও। তাঁর প্রচারে সেলিম অভিযোগ করছেন, রায়গঞ্জে এইমসের প্রতিশ্রুতি আগাগোড়াই ভাঁওতা। দীপার পাল্টা দাবি, ২০০৯ সালেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা রায়গঞ্জে এইমস করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন টালবাহানা করে। শেষ অবধি ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কিছু আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বিধানসভায় রায়গঞ্জে এইমস করা হবে বলে জানান। এরপর তৃণমূল সরকার এসে জমি অধিগ্রহণ করার বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেয়নি। তাই কৃষকরা জমি দিতে ইচ্ছুক হলেও কাজ এগোয়নি।
এইমস-এর ধাঁচে মেডিক্যাল কলেজ উত্তরবঙ্গে হলে তা বহু মানুষের প্রাণ বাঁচাবে, এমনই আশা রাজ্যবাসীর। সে সম্ভাবনা এখনও বিশ বাঁও জলে। আপাতত ভোটযুদ্ধে বিপক্ষকে আক্রমণের অস্ত্র হয়েছে এইমস।