এই সময়ে চাষযোগ্য স্বল্পমেয়াদি ডালশস্য বন্যায় অনাবাদি জমিতে হোক ডাল

জুলাই-অগস্ট মাসের ভারী বৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় চাষাবাদে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। জল নেমে গেলেও সমস্ত জমিতে পুনরায় ধান বা সব্জি চাষ করা সম্ভব হয়নি। যে জমি এখনও খালি রয়েছে, তাতে স্বল্প দিনের ডালশস্যের চাষ করে দেখতে পারেন চাষিভাইরা।

Advertisement

হরষিত মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০০:১৯
Share:

জুলাই-অগস্ট মাসের ভারী বৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় চাষাবাদে প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। জল নেমে গেলেও সমস্ত জমিতে পুনরায় ধান বা সব্জি চাষ করা সম্ভব হয়নি। যে জমি এখনও খালি রয়েছে, তাতে স্বল্প দিনের ডালশস্যের চাষ করে দেখতে পারেন চাষিভাইরা। রাজ্য কৃষি দফতরগুলিতে এখন বিনামূল্যে উন্নত জাতের ও গুণমানের ডালশস্যের বীজ দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, ডাল শস্যের চাষে মাটির উর্বরতা বাড়ে। বছরে একবার ডাল শস্য চাষ করলে প্রতি একরে ১২-১৫ কেজি নাইট্রোজেন যুক্ত হয়, যা ৩০ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। এই কারণে বছরে অন্তত একবার জমিতে ডাল শস্য চাষ করা ভাল।

Advertisement

মাটি তৈরি

Advertisement

বালি মাটি ছাড়া অন্য সব রকম মাটিতে ডাল শস্য চাষ করা যেতে পারে। কিন্তু দোআঁশ মাটি হল ডাল শস্য চাষের পক্ষে আদর্শ। প্রতি একরে দু’টন জৈব সার প্রয়োগ করার পর তিন-চারটি আড়াআড়ি ভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করার পর শোধিত বীজ লাইনে বা ছড়িয়ে বুনতে হবে।

বীজ শোধন

প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ ২.৫ গ্রাম অথবা ক্যাপটান ৭৫ শতাংশ ২ গ্রাম ভাল ভাবে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। যে জমিতে আগে ডালশস্য চাষ হয়নি, সেখানে বীজ বপন ও শোধনের এক সপ্তাহ আগে বীজের সঙ্গে অবশ্যই রাইজোবিয়াম কালচার মেশাতে হবে, এতে গাছের শিকড়ে অর্বুদের সংখ্যা বাড়ে এবং বেশি নাইট্রোজেন সঞ্চিত হয়। বাজারে প্রতিটি ডালশস্যের জন্য আলাদা আলাদা রাইজোবিয়াম কালচার পাওয়া যায়। যেমন,

ক) মটর গোষ্ঠীর (খেসারী, মসুর, মটর) জন্য রাইজোবিয়াম লিগুমিনোসেরাম।

খ) বরবটি গোষ্ঠীর (কলাই, ছোলা, মুগ, অড়হর) জন্য রাইজোবিয়াম প্রজাতি।

গ) সয়াবিন গোষ্ঠীর জন্য রাইজোবিয়াম জ্যাপোনিকাম।

বীজ বোনার এক সপ্তাহ আগে প্রতি একরের জন্য উক্ত কালচারের ৪০০ গ্রাম ভাতের ঠান্ডা ফ্যানের সঙ্গে মেশাতে হবে। এরপর বীজ শোধন করে জমিতে বুনতে হবে।

বোনার পদ্ধতি

বীজ ছড়িয়ে বোনার চেয়ে সারিতে বোনা ভাল। এতে বীজের পরিমাণ যেমন কম লাগে, তেমনই অন্তর্বর্তী পরিচর্যা করতে সুবিধা হয় ও ফলন বাড়ে। প্রতি একরে ছড়িয়ে বোনার জন্য খেসারীর ডাল লাগে ২৪ কেজি, মসুর ১৫, ছোলা ২৪, মটর ৩০। সারিতে বুনলে এই খেসারীই লাগবে একরে ১৮ কেজি্, মসুর ১২, ছোলা ১৮, মটর ২১ কেজি। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোনার সময়।

• খেসারী— নির্মল (এনসি-২৪) রতন, বায়ল-২১২।

• মসুর—সুব্রত (বিএম-৫৮), আশা ( বি-৭৭)

• ছোলা—সেচ এলাকায় মহামায়া-১ (বি-১০৮ ), মহামায়া-২ (বি-২১৫)।

অসেচ এলাকায় গঙ্গানগর ৪৬৯, এনডিজি-৯০২৯

• মটর—ধূসর (বি-২২), শঙ্কর, রচনা, আজাদ

সার প্রয়োগ

ডাল জাতীয় শস্যের শিকড়ে যে অর্বুদ হয়, তার গঠনে ফসফেট ও সালফার প্রয়োজন। সেই কারণে বীজ বোলার সময় ফসফেট ও সালফার ঘটিত সার যেমন অ্যামোনিয়াম সালফেট ৫০ কেজি বা এসএসপি দেড়শো কেজি প্রতি একরে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধিদশায় নাইট্রোজেন প্রয়োজন। তাই প্রতি একরে ইউরিয়া ৩০ কেজি, মিউরিয়েট অফ পটাশ ৪০ কেজি ও বোরাক্স ৩ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বোনার ৩০ থেকে ৪০ দিনের মাথায় ২ শতাংশ ডিএপি ও বোরিক অ্যাসিড এক গ্রাম এক সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করলে ডালের ফলন ভাল হয়।

জলসেচ

ডাল চাষে সাধারণত জলসেচের প্রয়োজন হয় না। কুয়াশা বা বৃষ্টির জলের উপর নির্ভর করেই এই চাষ হয়ে যায়। তবে বীজ বোনার আগে, ফুল আসা ও শুঁটি গঠনের সময় সেচের ব্যবস্থা থাকলে ভাল।

পোকা দমন

ডাল শস্যে প্রধানত শুটি ছিদ্রকারী পোকা, লেদা পোকা, বাঘা পোকা ও শোষক পোকা দেখা যায়। পোকা যাতে না লাগে তার জন্য প্রতি বর্গমিটারে ঠিকঠাক ৩০-৪০টি গাছ রেখে বাকিগুলো শিকড় সমেত তুলে ফেলতে হবে। এতে জমিতে আলো-বাতাসের চলাচল যেমন ভাল হবে তেমনই পোকার উপদ্রবও কম হবে। শোষক পোকা লেগে গেলে ১০ হাজার পিপিএম নিমতেল ২-৩ মিলি এবং ৩ গ্রাম ডিটারজেন্ট পাউডার এক সঙ্গে প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়। অথবা, ২০০ গ্রাম কাঁচা নিম পাতা, ২০ গ্রাম শুকনো লঙ্কা একসঙ্গে বেটে তার সঙ্গে ১০০ গ্রাম কাঁচা গোবর ও ২০০ মিলি জল মিশিয়ে কমপক্ষে এক সপ্তাহ পচাতে হবে। উক্ত দ্রবণ আরও এক লিটার জলে মিশিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এই দ্রবণ আরও ১০ লিটার জলে মিশিয়ে আঠা-সহ বিকেলের দিকে স্প্রে করলে শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই দু’টি উপায়ে কাজ না হলে রাসায়নিক হিসাবে ইমিডাক্লোপ্রিড ১৭.৮ শতাংশ ০.২ মিলি অথবা ডাইনোটিফিউরান ২০ শতাংশ ০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে আঠা-সহ বিকেলের দিকে স্প্রে করলে শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

শুটি ছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যাসিফেট ৭০ শতাংশ ০.৭৫ গ্রাম বা ইনডক্সাকার্ব ১৪.৫ এসসি ০.৭৫ মিলি বা স্পাইনোস্যাড ৪৫এনসি ০.১৫ মিলি প্রতি লিটার জলে আঠা-সহ মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর দু’বার বিকেলের দিকে স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যায়।

রোগ দমন

ডাল শস্যে প্রধানত ঢলে পড়া, গোড়া পচা, পাতা ধসা, সাদা গুঁড়ো, গুঁড়ো চিতি, মরচে প্রভৃতি রোগ দেখা যায়। এগুলি যাতে না হয় তার জন্য জমিতে নিকাশি ব্যবস্থা ভাল করতে হবে। বিশেষ করে মসুর চাষের জমিতে। কারণ, মসুর অতিরিক্ত জল একেবারে সহ্য করতে পারে না। তাই গাছ লাল হয়ে বসে যায় বা মরে যায়। রাসায়নিক হিসাবে ঢলে পড়া, গোড়া পচা রোগের জন্য কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০ শতাংশ ৪ গ্রাম অথবা কার্বেন্ডজিম ৫০ শতাংশ ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে গাছ ও মাটি ভিজিয়ে বিকেলের দিকে স্প্রে করতে হবে। সাদা গুঁড়ো ও গুঁড়ো চিতি রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মাইক্লোবুটালিন ১০ শতাংশ ০.৫ গ্রাম বা অ্যাজোক্সি স্ট্রবিন ২৫ শতাংশ ১ িমলি বা থায়োফানেট মিথাইল ৭০ শতাংশ ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।

লেখক খানাকুল ১ ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement