টেনশন নেই। তবে একটু কষ্ট আছে। সেটুকু সঙ্গে নিয়েই আজ, শুক্রবার গণনা-কেন্দ্রে ঢুকবেন তিনি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে কলকাতা থেকে আসানসোলের রণাঙ্গনে পৌঁছনোর আগে বলিউডের গায়ক তথা বিজেপি-প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় বললেন, “আমার মেয়েটাকে আসানসোলে নিয়ে যেতে না-পারার গ্লানি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।” মেয়ের পরীক্ষার ফল বেরনোর সময়ে তিনি যেমন তার স্কুলে গিয়ে হাজির হন, মেয়েও বাবার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর সাক্ষী হতে আসানসোলে হাজির থাকবেন চেয়েছিলেন বাবুল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মেয়ের বিমানের টিকিট বাতিল করতে হয়েছে।
কেন? বাবুলের বক্তব্য, “আসানসোলের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারছি না!” তাঁর কথায়, “এটা লজ্জার, বাংলার ভোটে সব জায়গায় ছোটদের নিয়ে যাওয়া যায় না!”
এই নিয়ে ভেতরে রক্তক্ষরণ হলেও বাবুল আপাত খোশমেজাজে রয়েছেন। ভিক্টোরিয়ায় মাঠে বরফগোলা চেখেছেন, ময়দানে বন্দুক ছুড়ে বেলুনে তাক করেছেন। তবে ভোটের লক্ষ্যভেদের জন্য কোনও টোটকার ধার ধারছেন না। বাবুলের কথায়, “আমি তুকতাক মানি না। ঠাকুর পুজোও করি না! দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি! বন্ধুরা কিছু বললে বলছি, তোরা যা খুশি কর! আমি কিচ্ছু করব না।”
সবার অবস্থা অবশ্য এক রকম নয়। বিজেপি-রই আর এক তারকা, শ্রীরামপুরের প্রার্থী বাপ্পী লাহিড়ি দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা, দেব-দেবীর আবাহনে মেতেছেন। চানের সময়ে পর্যন্ত খেয়াল রাখতে হচ্ছে, অসাবধানে কপালে আঁকা সিদ্ধি বিনায়কের জয়টীকা মুছে না যায়। ওই জয়টীকা কপালে নিয়েই এ বার শ্রীরামপুরে আসতে চান তিনি।
বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ের দাদারে সিদ্ধি বিনায়ককে পুজো চড়ানোর পরে বাপ্পীদা তাঁর জামাই গোবিন্দ বনশলের মাধ্যমে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরেও ভোগ নিবেদন করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে মুম্বই থেকে কলকাতার বিমান ধরার আগে বললেন, “সবাই জানে পশ্চিমবঙ্গে অবাধ ভোট হয়নি। তবু আমি হারছি না!”
ঘাটালে তৃণমূলের তারকা-প্রার্থী দেবের কিন্তু জেতা-হারা নিয়ে টেনশন নেই। বলছেন, “রাজনীতি আমার পেশা নয়। সুতরাং ছবি হিট বা ফ্লপ হওয়ার চাপটা ভোটে নেই।” দেশ জুড়ে ভোট-গণনার দিনেই কলকাতায় তাঁর নতুন ছবি ‘বিন্দাস’ নিয়ে মিটিং রয়েছে। একটি গানের দৃশ্যের মহড়াও দেওয়ার কথা। দেব বললেন, “কাউন্টিংয়ের পরের দিনই বিন্দাস-এর জন্য মুম্বইয়ে যেতে হবে। তবে জিতলে একবার চেষ্টা করব ঘাটাল ছুঁয়ে যেতে!”
এ রাজ্যের চতুর্মুখী ভোটযুদ্ধে তারকা কিংবা নবাগত প্রার্থীদের মধ্যে কাজ করছে এমনই নানা রঙের চিন্তার চোরাস্রোত। রোদে পুড়ে জলে ভিজে নাগাড়ে প্রচারের ঝক্কি সামলানোর পরে ফল নিয়ে উৎকণ্ঠা থাকাটাই স্বাভাবিক। বাঁকুড়ার তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেন যেমন দলের সহযোগীদের সঙ্গে এখনও প্রচারের টুকটাক খামতি নিয়ে আলোচনা করে চলেছেন! গণনার আগের সন্ধ্যায় হালকা জ্বর নিয়ে বাঁকুড়া ফিরেছেন তিনি। দলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, “ম্যাডাম ভেবে চলেছেন, কী করলে আরও ভাল হতে পারত!” মেদিনীপুরের প্রার্থী অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের ভাষায়, এটা ঠিক টেনশন নয়! এক ধরনের আকুতি! সন্ধ্যাদেবী বলছেন, “মানুষের সেবার ব্রতে সুযোগ পাব কি না, সেটাই শুধু ভাবছি!” জিতলে শংসাপত্র নিতে যাওয়া ছাড়া গণনার সময়ে অবশ্য বড় একটা কাজ নেই সন্ধ্যার।
ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী নবাগত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন রাত ১০টা পর্যন্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনায় শতাধিক কাউন্টিং এজেন্টের তালিমের দিকটা দেখছেন। বুকে ছিটেফোঁটাও ধুকপুকুনি নেই বলে দাবি করলেন। ফোনে বললেন, “ধুস আমার গলা কাঁপছে নাকি!” ভোটগুন্তির সময়ে দু-একবার গণনা কেন্দ্রে যাবেন বলে জানালেন। তাঁর কথায়, “আমার সঙ্গে মা-বাবার আশীর্বাদ, যিনি আমাকে এই সুযোগ দিয়েছেন, সেই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ রয়েছে। এই যথেষ্ট!”
মথুরাপুর কেন্দ্রের নবাগতা প্রার্থী, সিপিএমের রিঙ্কু নস্কর কিন্তু মানুষের আশীর্বাদ সঙ্গে আছে ধরে নিয়েও টেনশন ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। টানা প্রচারের ক্লান্তি নিয়ে যাদবপুরের বাড়িতে বিশ্রামের ফাঁকেই বলছিলেন, “এ টেনশন হল সন্ত্রাসের টেনশন!” জিতলে কর্মী-সমর্থকেরা মনোবল পাবেন, কিন্তু হারলে শাসক দলের জুলুমবাজির মুখে আরও কোণঠাসা হতে হবে! তবে রিঙ্কুর ভরসা, তিনি একা নন। বললেন, “দলের কমরেডরা আমায় সাহস জোগাচ্ছেন, আমিও তাঁদের সাহস জোগাচ্ছি!”
এমনই ভাবনা বালুরঘাটের তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষেরও। নিজেকে ঠান্ডা মাথার মানুষ বলেই মনে করেন তিনি। “আরে, মঞ্চে নতুন প্রোডাকশন নামানোর আগেও টেনশন হয় বই কি! এখানেও আমার সেরাটা দিয়েছি। এর বেশি ভেবে আমি মাথা খারাপ করতে রাজি নই,” হাসতে হাসতে বলছেন অর্পিতা। মালদহ (উত্তর) কেন্দ্রে তৃণমূলের তাস ভূমি-র সৌমিত্র আবার ফুরফুরে থাকতে সাইমন-গারফাঙ্কল থেকে নির্মলেন্দু চৌধুরী শুনে চলেছেন। বারাসতে কংগ্রেসের নবাগত প্রার্থী আইনজীবী ঋজু ঘোষাল অশোকনগরের গোলবাজারে গোগ্রাস ফুচকা খাচ্ছেন। বলছেন, “ফুচকা টেনশনের ভাল ওষুধ! দক্ষিণবঙ্গে আমরা (কংগ্রেস) প্রায় শূন্য থেকে শুরু করছি। ভাল ভোট টানাটাই নৈতিক জয়!”
জাদুকর পিসি সরকার (জুনিয়র) জীবনে হারের স্বাদ চেনেন না। বারাসতের বিজেপি প্রার্থী গণনাকেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবছেন। সঙ্গে হুঁশিয়ারি: “ভোট গোনার সময়ে দুষ্টু ম্যাজিকের চেষ্টা হলে ছেড়ে কথা বলব না!”