অনিল সিন্হা সিবিআইয়ের নতুন প্রধান নিযুক্ত হওয়ায় নিশ্চিত ভাবেই চাপে পড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এত দিন সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন অনিল। তিনি এ বার কেন্দ্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত হওয়ায় এক দিকে যেমন সারদা-তদন্তের গতি বাড়বে, তেমনই তদন্ত নতুন একটি খাতে বইতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ আস্থাভাজন সিবিআইয়ের নতুন ডিরেক্টর অনিল সিন্হা। ওয়াকিবহালরা জানেন, রঞ্জিত সিন্হা ডিরেক্টর থাকার সময়েও অনিলকে সরাসরি ফোন করে সারদা তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে খোঁজখবর নিতেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। তদন্তের গতিপ্রকৃতি এ বার কোন দিকে বইবে, তার একটি ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই কলকাতার এসে দিয়ে গিয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। ধর্মতলায় তাঁর বক্তৃতা থেকেই স্পষ্ট, সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ ও গত দু’বছরে এ রাজ্যে জাঁকিয়ে বসা জঙ্গি জালের যোগাযোগটি এ বার প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা হবে। আর এ কাজে অবশ্যই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায় পৌঁছে যাওয়া আহমেদ হাসান ইমরান। অভিযোগ, তিনি জঙ্গি সংগঠন সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসুর পরে এ বার ইমরানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চলেছে সিবিআই।
ইমরানের সঙ্গে মৌলবাদী জামাতে ইসলামি ও তার আশ্রয়ে থাকা জঙ্গিদের যোগসাজশ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার অনেক আগেই কূটনৈতিক ডসিয়ের দিয়ে দিল্লিকে অবহিত করেছিল। মমতা যে ইমরানের ‘পরিচয়’ জানতেন না, তা হয়তো ঠিক না। কারণ গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তৃণমূল নেত্রী রাজ্যসভায় দলের প্রার্থী হিসেবে ইমরানের নাম ঘোষণার পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী স্বয়ং দিল্লি থেকে কলকাতায় উড়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন। সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব মমতাকে একটি ফাইল দিয়ে বলেন, ইমরানের সন্দেহজনক কাজকর্ম ও জঙ্গি-যোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে রিপোর্ট রয়েছে। রাজ্যের আইবি-র সন্দেহের তালিকাতেও রয়েছেন এই ব্যক্তি। এমন এক জনকে রাজ্যসভায় প্রার্থী করার বিষয়টি মমতা যেন আর এক বার ভাবেন।
অনিল গোস্বামী নবান্ন ছাড়ার পরে তাঁর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমকে তা জানাতে অস্বীকার করেছিলেন মমতা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের এই সফরকে ‘রুটিন ও সৌজন্যমূলক’ বলে বর্ণনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তাঁর প্রার্থী তালিকায় কোনও হেরফের হয়নি। অনায়াসে সংসদে পৌঁছে যান জঙ্গি-যোগে অভিযুক্ত ইমরান।
সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআই ইমরানের কাছে বেশ কিছু নথি চেয়ে পাঠিয়েছিল। ইমরান সেই সব নথি সিবিআইকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সিবিআই শীর্ষ সূত্রের খবর, তদন্তকারী অফিসারেরা সেই নথি খতিয়ে দেখেছেন। কী আছে ওই নথিতে? সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, ইমরান তাঁর ‘কলম’ পত্রিকাটি সারদার মালিক সুদীপ্ত সেনকে বেশ কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করেছিলেন। সেই ব্যবসায়িক লেনদেনের নথিই চাওয়া হয়েছিল ইমরানের কাছে। সেই টাকা কোথায় গেল, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। সেই বিষয়েই এ বারও ইমরানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিবিআই। তৃণমূলের কোন শীর্ষ নেতার মধ্যস্থতায় তাঁর এই অখ্যাত পত্রিকা এত বিপুল অর্থে সারদাকে বিক্রি করা হল, তা-ও জানতে চাইবেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের জামাত ও সৌদি আরবের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের যোগাযোগের বিষয়েও জানতে চাওয়া হবে। ঠিক এই বিষয়টিই আশঙ্কায় রেখেছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। ইমরানকে নিয়ে এত হইচইয়ের পরেও মমতা কিন্তু দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি করেননি। তৃণমূলের সব কর্মসূচিতেই দেখা গিয়েছে তাঁকে। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের অভিযোগ, সারদা কেলেঙ্কারির টাকা বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ, এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র হলেন এই আহমেদ হাসান ইমরান। কলকাতায় অমিত শাহ বলেন, “তদন্তে সব তথ্য উঠে আসার পরে দিদি আর মুখ লুকোনোর জায়গা পাবেন না।” সংসদে দাঁড়িয়ে বিজেপির অনুরাগ ঠাকুরও একই অভিযোগ তুলেছেন। আজ সংসদে একটি প্রশ্নের জবাবে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জানিয়েছেন, ‘সারদার টাকা বাংলাদেশে সন্ত্রাসে মদতে পাঠানো হয়েছে, এমন কোনও খবর এখনও সিবিআই পায়নি। তবে তদন্ত চলছে।’ সংসদে মোদী সরকারের এই জবাবে তৃণমূল উৎফুল্ল। লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, “অমিত শাহের অবিলম্বে ক্ষমা চাওয়া উচিত। উনি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন।” কংগ্রেসের সঞ্জয় ঝায়ের মতে, “অমিত শাহ কেন মিথ্যা বললেন? সন্ত্রাস কী রসিকতার বিষয় নাকি?” খোদ ইমরানের বক্তব্য, “আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ উঠেছিল। আমি এ দেশের নাগরিক। কেন বাংলাদেশে টাকা পাঠাব?”
তৃণমূল এই যুক্তি দিলেও প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জানিয়ে দিয়েছেন, “মনে রাখতে হবে, সিবিআই যেমন সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে, তেমনই এনআইএ বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্ত করছে। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোও তদন্তে জড়িত।” জিতেন্দ্রই কর্মিবর্গ মন্ত্রকের দায়িত্বে। সিবিআই এই মন্ত্রকেরই অধীনস্থ। জিতেন্দ্র বলেন, “আমার মন্ত্রকের অধীনে একমাত্র সিবিআই রয়েছে। তাই আমি শুধু সিবিআইয়ের তরফেই জবাব দিতে পারি। আমি জানিয়েছি তদন্ত এখনও চলছে। তবে এখনও পর্যন্ত সিবিআই কোনও তথ্য পায়নি। আমি কাউকেই ক্লিনচিট দিচ্ছি না।” কর্মিবর্গ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, সিবিআই এখনও পর্যন্ত কোনও লেনদেনের খবর পায়নি বলেই এনআইএ বা আইবি কোনও তথ্য পায়নি, তা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ আগেই জানিয়েছিলেন, সারদার টাকা বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে তদন্ত চলছে। এনআইএ সেই কাজটিই করছে। আজকের প্রশ্নটি ছিল শুধুমাত্র সিবিআই তদন্ত সম্পর্কিত। তাই সিবিআইয়ের তরফে সংসদে এর বেশি কোনও তথ্য দেওয়া সম্ভব ছিল না।
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে, তার রহস্য উদ্ধারে ইমরান এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেন্দ্রের তরফে মমতাকে আগেই জানানো হয়েছিল, সিমি (স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া) প্রতিষ্ঠার সময় ইমরান ছিলেন সংগঠনের সভাপতি। তিন বছর তিনি ওই পদে ছিলেন। তার পরেও ইমরানই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে সিমি-র মুখ। সেই সিমি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে সদস্যরা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন তৈরি করে সন্ত্রাস অব্যাহত রাখে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় গোষ্ঠী সংঘর্ষে ইমরানের হাত রয়েছে বলে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশও রিপোর্ট দিয়েছিল। এর পরেও ইমরানকে রাজ্যসভায় পাঠানোর সিদ্ধান্তে মমতা অবিচল থাকায় তৃণমূলের সঙ্গে জামাতের সম্পর্কের বিষয়টি সামনে আসে।
সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে ইতিমধ্যেই দু’বার ইমরানকে জেরা করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ‘কলম’ পত্রিকাটি বিক্রি করলেও তার সম্পত্তি সারদাকে হস্তান্তর করেননি ইমরান। বাংলাদেশ ও এ দেশের গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, সারদা সংস্থার অ্যাম্বুলেন্সে ভরে নগদ টাকা বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠানো হতো। সেই টাকা জামাতের এজেন্টদের হাতে তুলে দেওয়া হতো। হাওয়ালা ও হুন্ডির মাধ্যমেও টাকা পাঠানো হতো। জেড্ডার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কেরও উচ্চ পদে ছিলেন ইমরান। যে ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জামাতে ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আজমের পুত্র মামুন আল আজম। ইমরানের অবশ্য বক্তব্য, “ওই ব্যাঙ্ক গরিব সংখ্যালঘু ছাত্রদের বৃত্তি দেয়। সেই বৃত্তির টাকা যাতে সঠিক ভাবে খরচ হয়, আমি তা দেখাশোনা করতাম।”
ইমরান এ কথা বললেও বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, “ইমরানের জঙ্গি-যোগ নিয়ে নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। সংবাদমাধ্যমেই এই নিয়ে বিস্তর রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রেও খবর ছাপা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থাকে উদ্ধৃত করেই সেই রিপোর্ট ও খবর প্রকাশ হয়েছে। যার ভিত্তিতেই সভাপতি এই মন্তব্য করেছেন। তৃণমূল যতই লাফাক, তাঁর মন্তব্যের সঙ্গে সংসদে আজ জিতেন্দ্র সিংহের জবাবের কোনও সম্পর্ক নেই।”
কিন্তু ইমরানকে ডাকার দিন যত এগিয়ে আসছে ততই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ আরও তীব্র করছেন মমতা।