আসিফের মুখেও মুকুল-সুদীপ্ত বৈঠক

কুণাল ঘোষ লিখেছিলেন। অরবিন্দ সিংহ চৌহান বলেছিলেন। এ বার বললেন আসিফ খান। দাবি করলেন, কলকাতা থেকে পালানোর আগে সুদীপ্ত সেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের সঙ্গে নিজাম প্যালেসে বৈঠক করেছিলেন। এই একই কথা এর আগে সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-কে লেখা তাঁর ৯১ পাতার চিঠিতে বলেছিলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৩
Share:

কুণাল ঘোষ লিখেছিলেন। অরবিন্দ সিংহ চৌহান বলেছিলেন।

Advertisement

এ বার বললেন আসিফ খান।

দাবি করলেন, কলকাতা থেকে পালানোর আগে সুদীপ্ত সেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের সঙ্গে নিজাম প্যালেসে বৈঠক করেছিলেন।

Advertisement

এই একই কথা এর আগে সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-কে লেখা তাঁর ৯১ পাতার চিঠিতে বলেছিলেন। কুণালের দাবি ছিল, ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল নিজাম প্যালেসের ওই বৈঠকে সুদীপ্ত-মুকুল ছাড়াও প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, সারদার অন্যতম কর্তা সোমনাথ দত্ত এবং তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন।

দু’দিন আগে জামিনে ছাড়া পেয়ে সুদীপ্তর গাড়িচালক অরবিন্দ সিংহ চৌহান দাবি করেছিলেন, বৈঠকের দিন তিনিই গাড়ি চালিয়ে সুদীপ্তকে নিজাম প্যালেসে নিয়ে যান। নিজাম প্যালেসে সুদীপ্তর সঙ্গে মুকুলকে তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন।

একদা মুকুল-ঘনিষ্ঠ, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানও এ বার ওই বৈঠক নিয়ে মুখ খুললেন। কী করে জানলেন এই বৈঠকের কথা? প্রশ্ন করলে আসিফ রাতে আনন্দবাজারকে বলেন, “মালিকের কথা কর্মচারী যে ভাবে জানে, সে ভাবেই জানি! অরবিন্দ যে ভাবে সুদীপ্তর কথা জানেন, আমিও সে ভাবেই মুকুল রায়ের কথা জানি!” আসিফেরও দাবি, ওই বৈঠকে মুকুলবাবুর সঙ্গে সুদীপ্ত-কুণাল-রজত-সোমনাথ ছিলেন।

সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল, সুদীপ্ত-ঘনিষ্ঠ অরবিন্দ এবং এ দিন মুকুল-ঘনিষ্ঠ আসিফ পরপর তিন জন ওই বৈঠকের কথা সামনে আনার পরে সারদা এবং সারদা-কর্তা সুদীপ্তর সঙ্গে মুকুল রায়ের যোগাযোগ বা ঘনিষ্ঠতা আরও মান্যতা পেল বলে মনে করা হচ্ছে। জানা গিয়েছে, এই তিন জনই বিভিন্ন সময়ে মুকুল-সুদীপ্ত বৈঠকের কথা সিবিআইকেও জানিয়েছেন। এ দিন সিবিআই-অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা আনন্দবাজারকে বলেন, “আমরা এই তিন জনের কথাই খতিয়ে দেখছি। তার পরেই যা করার করা হবে।”

এর আগে কুণাল বা অরবিন্দের বক্তব্য নিয়ে মুকুল রায় কোনও মন্তব্য করেননি। এ দিনও তাঁর একই প্রতিক্রিয়া, “মন্তব্য করব না।”

এ দিন অবশ্য নিজাম প্যালেসের বৈঠকের কথা বলেই থামেননি আসিফ। তাঁর অভিযোগ, সারদা মামলায় সিবিআই তদন্তের পক্ষে সওয়াল করার ফলেই দল তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। তাঁকে পুলিশি হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। মুকুলের প্রাক্তন সহচরের বিস্ফোরক দাবি, “সারদা মামলায় রাজ্য পুলিশের সিট যে তদন্ত করছিল, খাতায়কলমে তার দায়িত্বে ছিলেন বিধাননগরের কমিশনার রাজীব কুমার। আসল তদন্তটা চালাচ্ছিলেন মুকুল রায়।” এ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজীব কুমারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি।

আসিফ আরও বলেন, “দিল্লির সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মুকুলবাবুর হাতে আমি সিবিআইকে লেখা সুদীপ্তের চিঠি দেখেছিলাম। মুকুলবাবু জাহাজমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর এক অধস্তন মহিলা ওএসডি (অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি) ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিলেন সিবিআইতে। সেই সূত্রেই সুদীপ্তর ওই চিঠির প্রতিলিপি হাতে পান মুকুলবাবু।” আসিফের দাবি, ওই চিঠির প্রতিলিপি জোগাড় করার কথা মুকুল নিজেই ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে তাঁকে বলেছিলেন। মুকুল ওই চিঠি পাওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই কলকাতা ছেড়ে পালান সুদীপ্ত।

মুকুলের সঙ্গে আসিফের এই সম্পর্ক তৈরি হল কী ভাবে? ২০০৮ সাল থেকে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন আসিফ। ২০০৯ সালে তিনি দলে যোগ দেন। তখন থেকেই মুকুলের কাছাকাছি আসেন। উত্তরপ্রদেশে দলের পর্যবেক্ষকও হন। সারদা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার চাপেই আসিফ সাময়িক ভাবে সারদার অধীনে থাকা ‘কলম’ পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। পরে ‘কলম’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি ‘আজকের কলম’ নামে একটি খবরের কাগজ চালু করেন। মাস কয়েক আগে ‘আজকের কলম’ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

এর মধ্যে বছরখানেক ধরে দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল আসিফের। সারদা মামলায় তাঁর নামও জড়িয়ে গিয়েছিল। ইডি, সিবিআই তাঁকে জেরা করেছে। কুণালের মুখোমুখি বসিয়েছে, তাঁর পার্ক সার্কাসের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে। এ মাসের ৮ তারিখ সিবিআই-এর জেরার পরে আসিফ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দলের নেতাদের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরেছি। যা দেখেছি, যা শুনেছি, সবই সিবিআই-কে বলেছি।” কী সেই তথ্য? আসিফ সে দিন বলেছিলেন, “প্রকাশ্যে বললে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়ে যাবে।”

মাস না-ঘুরতেই আসিফ কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খুললেন। এ দিন প্রতারণা সংক্রান্ত একটি ভিন্ন মামলায় সল্টলেক কমিশনারেটে ডেকে পাঠানো হয়েছিল আসিফকে। এই মামলায় পুলিশ আগে এক বার তল্লাশিও চালিয়েছিল আসিফের বাড়িতে। আসিফের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের ব্যবসায়ী ওয়াইদুল হাসান সিদ্দিকি ২০ কোটি টাকার প্রতারণার মামলা করেছেন বলে পুলিশের দাবি। আসিফের পাল্টা

দাবি, তিনি সারদার সঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের নাম জড়িয়ে দেওয়ার ফলেই এই হেনস্থা। কমিশনারেট থেকে বেরিয়ে আসিফ এ দিন বলেন, “সিদ্দিকি উত্তরপ্রদেশের তৃণমূলের কার্যনির্বাহী সভাপতি। আমি ওই রাজ্যেরই পর্যবেক্ষক ছিলাম। ওকে চিনি। আমার সামনেই সুদীপ্তর সঙ্গে দেখা করে সিদ্দিকি চ্যানেল কিনতে চেয়েছিলেন।” রাতে ফোনে আনন্দবাজারের কাছে আসিফ আরও দাবি করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই একটি চ্যানেলের অনুমোদন পাওয়া গিয়েছিল তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অম্বিকা সোনির কাছ থেকে। প্রথমে সেই চ্যানেলের মালিকানা নিয়েছিলেন এ রাজ্যের এক চিত্রশিল্পী। পরে তা সুদীপ্তর হাতে যায়। সিদ্দিকিকে চ্যানেল বিক্রির কথাবার্তার সময় আসিফকে সঙ্গে থাকতে বলেছিলেন মুকুলই। কী দায়িত্ব ছিল তাঁর? আসিফের দাবি, “আমি টাকাপয়সার ব্যাপারে জড়িত ছিলাম না। মুকুলদার কথামতো চা-জল আনার কাজ করতাম। আমাকে বলা হয়েছিল, ওঁরা কাগজপত্র দেবেন, আমি যেন নিয়ে আসি।” শেষ পর্যন্ত সেই কাগজও হাতে পাননি বলে আসিফের দাবি। তাঁর কথায়, “মুকুলদাকে জানালে উনি বলেন, ওটা কুণাল দেখে নেবে।”

বছরখানেক যাবৎ সম্পর্কে চিড় ধরার পরে অবশেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক বৈঠক করে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেন আসিফ। মুকুল রায় তথা দলের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নষ্ট হল কেন? আসিফের দাবি, দল যে ভাবে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করছিল, তিনি সেটা মানতে পারেননি। দলের ভিতরে তো বটেই, প্রকাশ্যেও একটি চ্যানেলে নিজের মত জানান। আসিফের অভিযোগ, “তার পর থেকেই রাজ্য সরকার আমার শত্রু হয়েছে। সততার ব্র্যান্ড কোথায় গেল? যাঁদের বিরুদ্ধে বলছি, তাঁদের কাছ থেকে প্রাণহানির আশঙ্কা করছি।”

এ দিন কমিশনারেটে ঢোকার মুখে আসিফের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে সুদীপ্ত-র বৈঠক হয়েছিল বলেও জানান অরবিন্দ চৌহান। আসিফের জবাব আসে, “সব নেতাই সারদার টাকা নিয়েছেন। যদি এমন নেতা দেখাতে পারেন যিনি টাকা নেননি, আমি তাঁর দলে নাম লেখাব।” রাতে আনন্দবাজারের তরফে তাঁকে প্রশ্ন করা হয় কুণাল ঘোষ যে বলেছেন সারদা থেকে সব চেয়ে বেশি সুবিধা মমতা পেয়েছেন, সে কথা মানেন কি?

দলের প্রাক্তন সদস্যের উত্তর, “তৃণমূল মমতার সন্তান। সন্তানের বাড়বৃদ্ধিতে মায়ের আনন্দ। আনন্দ আর সুবিধা একই কথা।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement