আদালতে মমতার নাম নিলেন মদনও

সারদা কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে আবার আদালতে উঠে এল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর একনিষ্ঠ সৈনিক, সারদায় অভিযুক্ত মন্ত্রী মদন মিত্র আদালতে দাঁড়িয়ে মমতার নাম তুলে আনলেন। ঠিক যেমন, গত ১১ সেপ্টেম্বর এই আলিপুর আদালতে দাঁড়িয়েই কোনও প্রসঙ্গ ছাড়াই ‘কৌশলে’ মমতার নাম উল্লেখ করেছিলেন তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদার। মঙ্গলবার কার্যত তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল মদনবাবুর মুখেও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:১৭
Share:

আলিপুর আদালতে মদন মিত্র। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

সারদা কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে আবার আদালতে উঠে এল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।

Advertisement

এ বার মুখ্যমন্ত্রীর একনিষ্ঠ সৈনিক, সারদায় অভিযুক্ত মন্ত্রী মদন মিত্র আদালতে দাঁড়িয়ে মমতার নাম তুলে আনলেন। ঠিক যেমন, গত ১১ সেপ্টেম্বর এই আলিপুর আদালতে দাঁড়িয়েই কোনও প্রসঙ্গ ছাড়াই ‘কৌশলে’ মমতার নাম উল্লেখ করেছিলেন তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদার। মঙ্গলবার কার্যত তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল মদনবাবুর মুখেও।

সারদা-কাণ্ডে প্রভাবশালীদের ভূমিকা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি সারদার বিপুল পরিমাণ নয়ছয় হওয়া টাকার সুবিধা কারা পেয়েছিলেন, তা নিয়ে বিস্তারিত তদন্তে নেমেছে সিবিআই। অভিযোগ উঠেছে, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সারদার বিপুল পরমাণ টাকা গিয়েছিল তৃণমূলের তহবিলে। সিবিআই সূত্রের খবর, মঙ্গলবার সকালে মদনবাবুকে আদালতে আনার আগে বারবার এই বিষয়েই প্রশ্ন করেছেন তদন্তকারীরা। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ২০১১ সালে সারদার কত টাকা দলীয় তহবিলে এসেছিল? কে সেই টাকা নিয়েছিলেন? মদনবাবুর জবাব কী ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসেছেন তদন্তকারীরা।

Advertisement

মদনবাবুকে জেরার এই সব প্রসঙ্গ অবশ্য এ দিন ওঠেইনি আদালতে। কিন্তু আচমকাই নিজের জামিনের জন্য আবেদন করতে গিয়ে মদনবাবু বলে ওঠেন, “ওঁরা (সিবিআই) আমাকে দিয়ে জোর করে বলিয়ে নিতে চাইছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাকা নিয়েছেন। আমি বলিনি। বলব না।”

প্রশ্ন উঠেছে, আদালতে কেউ মদনবাবুকে মমতার নাম বলতে বলেননি। তা হলে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কেন আচমকা মমতার নাম তুললেন তিনি? ১১ সেপ্টেম্বর ঠিক এ ভাবেই তৃণমূল নেতা তথা প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারও আচমকাই নিজে থেকে বলে উঠেছিলেন, “সাত দিন কেন, সত্তর দিন হেফাজতে রাখুন। কিন্তু মমতা-মুকুলকে টাকা দিয়েছি, তা বলাতে পারবেন না।” তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, তা হলে কি প্রকারান্তরে রজত বলতে চাইছেন যে তিনি মমতা, মুকুলকে টাকা দিয়েছিলেন? কৌশলে সেটাই আদালতে তুলে দিলেন পোড় খাওয়া আইপিএস অফিসার!

এ দিনও একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে আদালত চত্বরে। অনেকেরই প্রশ্ন, মদনবাবু কি ঠারেঠোরে জানিয়ে দিলেন, যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, তার ভাগীদার তিনি একা নন! দলের শীর্ষস্তরের অন্যরাও তার ভাগ পেয়েছেন।

সিবিআই হেফাজতে মদনবাবু যে বেশ চাপে আছেন, এ দিন আদালতে জামিনের জন্য তাঁর আকুতি থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবারেও আদালতে নিজেই সওয়াল করেন মদন। এ দিন করজোড়ে বিচারক হারাধন মুখোপাধ্যায়কে বললেন, “স্যার, দয়া করে আমাকে আর সিবিআই হেফাজতে পাঠাবেন না। ওখানে গেলে আমি মরে যাব।” তাঁর অভিযোগ, “সিবিআই আমার উপরে মানসিক অত্যাচার করছে। আমাকে জেরা করার নামে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। আমার সামনে চার জন অফিসার চুপ করে বসে থাকছেন। কোনও কথাই বলছেন না। কখনও জোর করে আমার আওয়াজ রেকর্ড করে রাখছে। স্যার! আমি চোর না ডাকাত!”

এ দিন আদালতে সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থসারথি দত্ত প্রথমেই বলেন, “গত তিন দিন মদনগোপাল মিত্রকে জেরা করে স্পষ্ট হয়েছে, তিনি সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাঁর কাছ থেকে অনেক তথ্য (ইলেকট্রনিক ডেটা) পাওয়া গিয়েছে। তা চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হবে। এই অবস্থায় তাঁর থেকে আরও কিছু তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” এই মামলায় সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার ফণীভূষণ কর্ণ আদালতে জানান, অভিযুক্তকে জেরা করে আরও নতুন নতুন তথ্য ও নাম উঠে এসেছে। তা খতিয়ে দেখার জন্যই তাঁকে আরও জেরা করা দরকার।

কিন্তু সেই জেরার সামনে আর বসতে চান না মন্ত্রী। তিনি বিচারককে বলেন, “স্যার, আমরা ১৮৮৭ সাল থেকে কলকাতায় রয়েছি। যে কোনও শর্তে আমাকে জামিন দিন। আমি পালাব না। আমি সর্বতো ভাবে সিবিআইকে সহযোগিতা করব।” তিনি বলেন, “স্যার, আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। এই কারণে আমি মনোবিদদের পরামর্শও নিচ্ছি। সিবিআই আমাকে নিজেদের হেফাজতে চেয়ে আরও বেশি অত্যাচার করার পরিকল্পনা করছে। আপনি আমাকে বাঁচান।”

এ দিন মন্ত্রীর নিজস্ব সওয়ালের আগে তাঁর আইনজীবী অশোক মুখোপাধ্যায় জামিনের আবেদন করে বলেন, মদন মিত্রের নাম চার্জশিটে নেই। এখনও পর্যন্ত কেউ কোথাও এমন অভিযোগ করেননি যে, মদন মিত্রের কথা মতো তিনি সারদায় টাকা রেখে ডুবেছেন। ৫৮টি মামলার একটিতেও নাম নেই মদনের। অশোকবাবুর প্রশ্ন, যেখানে চার্জশিটে নাম থাকা সত্ত্বেও সজ্জন অগ্রবালকে গ্রেফতার করা হয়নি, সেখানে কেন মদন মিত্রকে গ্রেফতার করা হল? অন্য কোনও অভিযুক্ত (এ ক্ষেত্রে সুদীপ্ত সেন ও কুণাল ঘোষ) যদি মদন মিত্রের নাম করেন, তা হলে সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? অন্য এক আইনজীবী অভিযোগ করেন, “অসুস্থ মদন মিত্রের ঠিক মতো চিকিৎসা করাচ্ছে না সিবিআই। তাঁর প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”

দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক মদনবাবুকে আরও তিন দিন সিবিআই হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ শোনার পরে আরও গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন রাজ্যের পরিবহণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী। কয়েক হাত দূরে আদালত কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর স্ত্রী, পুত্রবধূ ও পরিবারের অন্যরা। মন্ত্রী এগিয়ে যেতেই কেঁদে ফেলেন তাঁরা। চোয়াল শক্ত করে আদালত কক্ষ ছাড়েন মদনবাবু।

এ দিনও আদালতের সামনে জড়ো হয়েছিলেন মদন-সমর্থকেরা। হাতে ফুল নিয়ে তাঁরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছেন রাস্তার উপরে, আদালত চত্বরেও। স্লোগানও দিয়েছেন। দুপুর তিনটে নাগাদ মদনকে নিয়ে পুলিশের গাড়ি আদালতে ঢোকার পথে তাঁর গাড়ি লক্ষ করে ফুল ছোড়া হয়, শঙ্খধ্বনিও করা হয়। তবে শনিবারের মতো বিশৃঙ্খলা হয়েছিল এ দিন দেখা যায়নি। উল্টে মদনবাবুকে ফের সিবিআই হেফাজতে পাঠানো হচ্ছে শুনে অনেক কর্মী-সমর্থকই ভেঙে পড়েন। সন্ধ্যায় সিবিআই অফিসে ঢোকার মুখে মদনবাবু ফের বলেন, “আমার উপর মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ। মোদীর গুন্ডারাজ খতম করা হোক।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement