অভিজিৎ চক্রবর্তীর সাংবাদিক বৈঠক। মঙ্গলবার প্রেস ক্লাবে। নিজস্ব চিত্র
এত দিনের আশীর্বাদী হাত সরিয়ে নিয়ে সোমবারই তাঁকে উপাচার্যের পদ থেকে বিদায় করেছে নবান্ন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দাঁড়িয়ে গত চার মাসের অচলাবস্থার জন্য কার্যত তাঁকেই দায়ী করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। আর এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাল্টা আসরে নেমে রাজ্য সরকারকেই কাঠগড়ায় তুললেন যাদবপুরের সদ্য-প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী।
যাদবপুরের যে ছাত্র-আন্দোলনকে প্রশংসা করে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে, মঙ্গলবার এক সাংবাদিক বৈঠকে তাকে ‘জঙ্গি আন্দোলন’ বলার পাশাপাশি সোমবার, তাঁর পদত্যাগের দিনটাকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিতও করে ফেললেন! আর সেই সঙ্গে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশি তাণ্ডবের দায়ও সুকৌশলে চাপিয়ে দিলেন পুলিশ ও সরকারের ঘাড়ে!
সোমবার মুখ্যমন্ত্রী সটান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের সামনেই রেজিস্ট্রারের মোবাইল থেকে অভিজিৎবাবুকে টেলিফোন করে কথা বলেন এবং তার পরে শিক্ষামন্ত্রীর মোবাইলে পদত্যাগের ইচ্ছে প্রকাশ করে এসএমএস করেন অভিজিৎবাবু। তা নিয়ে এর মধ্যেই সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে শিক্ষামহলে। এ ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা যায় কি না, প্রশ্ন উঠে গিয়েছে তা নিয়ে। বাম আমলে শিক্ষার ‘অনিলায়ন’-এর প্রসঙ্গ তুলে কেউ কেউ বলেছেন, এই ঘটনা তাকেও ছাপিয়ে গেল। এ নিয়ে মঙ্গলবার প্রশ্ন করা হলে শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যাবেন না তো কে যাবেন? উনি গিয়েছেন, ভালই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠলে উঠতে দিন।”
এক দিনের মধ্যে সমালোচনাকে আরও উস্কে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিলেন অভিজিৎবাবু নিজেই। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিদায়ী উপাচার্য এক দিকে শুধু নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলেই ক্ষান্ত হলেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন আইন মতে তিনি নিজে থেকে ইস্তফা না দিলে কেউ তাঁকে জোর করে পদত্যাগ করাতে পারবেন না। তা হলে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী এমন কী বললেন, যে জন্য তিনি পদত্যাগ করলেন? তাঁর জবাব, “পদত্যাগের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভাবে আমার ব্যক্তিগত। আমার কখন কী মনে হল, সেটা তো কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।”
অথচ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, সোমবার শিক্ষা ও প্রশাসনিক জগতে একটি কালা দিবস। কেন? অভিজিৎবাবুর কথায়, “কারণ অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক দাবি-আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে এক উপাচার্যকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হল শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে।”
যাদবপুরের ছাত্র-আন্দোলন প্রসঙ্গে এখনও যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন অভিজিৎবাবু। এ দিনও তিনি বলেছেন, পড়ুয়াদের বোঝা উচিত, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর মদ ও গাঁজার মতো নেশার জায়গা নয়। ১৬ সেপ্টেম্বর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাউকে পণবন্দি করে রাখার অধিকার কারও নেই। তাই মুক্ত হওয়ার আর্জি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কী করবে, সেটা পুলিশের ব্যাপার। ওই রাতের তাণ্ডবের দায় এ ভাবে লালবাজারের উপরে চাপানোর পাশাপাশি নবান্নকেও বিঁধতে ছাড়েননি তিনি। বলেন, “পুলিশ নিশ্চয়ই সরকারের অনুমতি নিয়েই এসেছিল!” সে রাতে পুলিশ ডাকার সিদ্ধান্ত তাঁর একার ছিল না বলেই দাবি অভিজিৎবাবুর। তাঁর কথায়, “ওই দিন এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠকের পরে শিক্ষক, (তৎকালীন) সহ-উপাচার্য, ডিন-সহ সকলের সঙ্গে আলোচনা হয় পুলিশ ডাকার ব্যাপারে। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।” যদিও তৎকালীন সহ-উপাচার্যের দাবি, তিনি পুলিশ ডাকার ব্যাপারে কিছু জানতেন না। এর প্রতিবাদে তিনি অনেক আগেই ইস্তফা দেন।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানান, সেই রাতে পুলিশ কী করেছে, তাতে সরকারের কোনও ভূমিকা ছিল না। তিনি বলেন, “উপাচার্যই লিখিত ভাবে পুলিশকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আর্জি মেনে পুলিশ গিয়েছিল। এর বাইরে সরকারের কোনও ভূমিকা ছিল না।” এখন ঘুরিয়ে সরকার ও পুলিশের ঘাড়ে দায় চাপালেও এই অভিজিৎবাবুই ঘটনার কিছু দিন পরে একটি শিক্ষক সংগঠনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সন্তানতুল্য। পুলিশি তাণ্ডবের দায় কার্যত স্বীকার করে নিয়ে দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন তখন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজভবনে গিয়ে ইস্তফাপত্র জমা দেন অভিজিৎবাবু। আচার্য-রাজ্যপালকে লেখা তাঁর ইস্তফাপত্রেও বিশৃঙ্খল ছাত্রছাত্রীদের জঙ্গিপনার কথা অভিজিৎবাবু বলেছেন বলে রাজভবন সূত্রের খবর। ওই সূত্রেই জানা গিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর আবেদনের পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে যে যাদবপুরের এক শ্রেণির শিক্ষক রাজনীতি করছেন, সে কথাও ইস্তফাপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন। রাজ্যপাল অবশ্য আপাতত কলকাতায় নেই।
রাজভবনে যাওয়ার আগে ঘণ্টাখানেকের সাংবাদিক বৈঠক করেন অভিজিৎবাবু। লিখিত প্রেস নোটে তিনি জানান, কয়েক জন ছাত্রের অগণতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে নয়, তিনি পদ ছাড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে। যাদবপুরের মতো প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে তিনি ব্যর্থ বলেও জানিয়েছেন অভিজিৎবাবু। আন্দোলনকারী ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটার কয়েক জন সদস্যের তৈরি নৈরাজ্যের প্রতিবাদেও তাঁর এই পদত্যাগ বলে দাবি অভিজিৎবাবুর।
কিন্তু তাঁর এ দিনের দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সব মহলেই। যেমন, তাঁর নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করা। তিনি যে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ, সেই অভিযোগ পুরনো। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভামঞ্চেও তাঁকে দেখা যায় ২০১৩-য়। তখন তিনি উচ্চশিক্ষা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান।
বিতর্ক অবশ্য এরও আগে থেকে অভিজিৎবাবুর সঙ্গী। বেসু-র শিক্ষক অভিজিৎবাবু যখন ২০১১-র শেষে অস্থায়ী ভাবে যাদবপুরের উপাচার্য পদের দায়িত্ব পান, তখন তাঁর নিয়োগপত্রে রাজ্যপালের জায়গায় তৎকালীন উচ্চশিক্ষা সচিবের স্বাক্ষর থাকায় তা নিয়ে বিতর্ক বাধে। ২০১২-য় যখন আইআইটি-খড়্গপুরের শিক্ষক শৌভিক ভট্টাচার্য উপাচার্যের দায়িত্ব পান, তখন অভিজিৎবাবুকে উচ্চশিক্ষা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। পদটি তাঁর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয় বলে উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর।
২০১৩-য় শৌভিকবাবু পদত্যাগ করার পরে ফের অস্থায়ী ভাবে দায়িত্ব পান অভিজিৎবাবু। শৌভিকবাবুর পদত্যাগের পিছনে অভিজিৎবাবুর প্রচ্ছন্ন হাত ছিল বলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রের খবর। যদিও শৌভিকবাবু নিজে কখনও এ নিয়ে মুখ খোলেননি, অভিজিৎবাবুও অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশি তাণ্ডবের পরেও তাঁকেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী উপাচার্য করা হয়। সরকারের হাত আছে বলেই বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজ্যপাল অভিজিৎবাবুকেই স্থায়ী করেন বলে রাজভবনের একটি সূত্রের খবর।
অভিজিৎবাবু এ দিন বলেছেন, তাঁর ইস্তফার পিছনে কোনও রাজনৈতিক চাপ নেই। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর এই দাবি নিয়েও। তৃণমূল সূত্রে খবর, কিছু দিন আগেই অভিজিৎবাবুকে উপাচার্য পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। ঘোষণাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন যে, রাজনৈতিক চাপ যদি না-ই থাকে, তবে মমতা যাওয়ার পরে কেন ইস্তফা দিতে রাজি হলেন তিনি? এই বিষয়ে তিনি যে ভাবনাচিন্তা করছেন, আগের দিনও তা বোঝা যায়নি তাঁর কথাবার্তা থেকে! তবে চাপ একটা তৈরি হয়েছিল, সেটা মানছেন প্রশাসনিক মহলের অনেকেই। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সির ছাত্রী সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে মন্তব্য করে শাসকদলকে বিড়ম্বনায় ফেলছিলেন অভিজিৎবাবু। এর মধ্যে গত শনিবার আচার্য-রাজ্যপাল প্রেস বিবৃতি দিয়ে তাঁকে সতর্ক করেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর বিরুদ্ধে আওয়াজ জোরালো হয়ে উঠছিল। শিক্ষক সংগঠন জুটার সাধারণ সম্পাদক নীলাঞ্জনা গুপ্ত বলেন, “নৈরাজ্য ও হিংস্রতা ছড়াচ্ছেন উপাচার্যই। যাদবপুরের ৯৭ শতাংশ ছাত্র ও ৮৫ শতাংশ শিক্ষক অভিজিৎবাবুকে চান না। বোঝাই যাচ্ছে, যাদবপুরকে ওঁর পছন্দ হয়নি আর যাদবপুরের অধিকাংশ মানুষই অভিজিৎবাবুর পদত্যাগ চেয়েছেন।”
এর পরেই সোমবারের ঘটনাপ্রবাহ। অভিজিৎবাবুর ইস্তফার দাবিতে আট দিন ধরে আমরণ অনশন চালাচ্ছিলেন পড়ুয়ারা। মমতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সেই আন্দোলনকে প্রশংসা করেন। ফোনে কথা বলেন অভিজিৎবাবুর সঙ্গেও। এর পরেই আসে ইস্তফার ঘোষণা। যাকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু বলছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এমনকী অভিভাবকদেরও একাংশ রাজনীতি এনে ফেলছিলেন। তবে এখন সব ভালয় ভালয় মিটে গিয়েছে। আর কোনও বিতর্ক চাই না।” আর আন্দোলনকারী ছাত্রী গীতশ্রী সরকার বলছিলেন, “শাসক দলের অনেক নেতাই আমাদের আন্দোলনকে ছোট করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে মাথা নোয়াতে হল তাঁদের।” কিন্তু এই ইস্তফা-পর্বের পিছনে রাজনীতিটা গীতশ্রীও বুঝতে পারছেন। বললেন, “উপাচার্য রাজনীতি নিয়ে কী বলছেন! উনি নিজেই তো রাজনীতির শিকার!”