মুখোমুখি। বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। বুধবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
উদ্বোধনে আড়ম্বর রইল। রাজ্যে লগ্নি আসার ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে পাশে পাওয়ার আশ্বাসও মিলল। থাকল শিল্পের জন্য লাল কার্পেটের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট’-এর মঞ্চেও নিজের জমি-নীতি থেকে এক ইঞ্চি সরলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি শব্দও খরচ করলেন না অধিগ্রহণ সম্পর্কে। ইঙ্গিত দিলেন না জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন তুলে নেওয়া বিষয়ে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই শিল্পমহলের প্রশ্ন, সেই জমির কাঁটা যদি থেকেই যায়, তবে আর এত ঘটা করে সম্মেলন করে লাভ কী? জমি ছাড়া শিল্প হবে কোথায়? একই প্রশ্ন বিজেপির রাজনৈতিক মঞ্চে তুললেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও।
সাড়ে তিন বছরে তিনটি শিল্প সম্মেলন। শিল্পকর্তাদের সঙ্গে বিজয়া সম্মিলনী। লগ্নি টানতে ভিন্ রাজ্য বা দেশে ‘রোড শো’। কোথাওই জমি-নীতি নিয়ে ঘোষিত অবস্থান থেকে সরেননি মুখ্যমন্ত্রী। ফলে শিল্পের ভাঁড়ারেও কিছু জমেনি। বুধবারও সেই জায়গাতেই আটকে রইলেন তিনি। কাটা রেকর্ডের মতো বাজালেন সেই জমি-ব্যাঙ্কের কথা। জানালেন, জমি-ব্যাঙ্ক (ল্যান্ড ব্যাঙ্ক) তৈরি। হাতের কাছে মজুত রয়েছে জমির মানচিত্র এবং সেই জমি ব্যবহারের নীতি। এক কথায় বলে দিলেন, “জমির কোনও সমস্যা নেই।” অধিগ্রহণ নিয়ে সরকারের নীতি কী, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনে রেহাই দিতে ১৪-ওয়াই ধারায় ছাড় বাড়ানো বা তুলে দেওয়া হবে কি না এ সব নিয়ে একটি শব্দও খরচ করলেন না। কেন্দ্রের নতুন জমি অর্ডিন্যান্স তো দূর, অধিগ্রহণ নিয়ে স্পষ্ট কোনও আশ্বাসও শোনা গেল না মমতার কণ্ঠে।
এই পরিস্থিতিতে আদৌ শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি সম্ভব? এই প্রশ্ন রাজ্য প্রশাসনেরই একটি বড় অংশের। তাঁদের বক্তব্য, জমি-ব্যাঙ্ক বলে যা দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে বড় শিল্প হওয়া কঠিন। বাস্তব পরিস্থিতি হল, বড় মাপের শিল্প গড়তে গেলে জমি অধিগ্রহণ করতেই হবে সরকারকে।
“জমি নিতে না দিলে, আমরা থাকব কোথায়? জঙ্গলে? আমরা কি তা হলে আধুনিক,
প্রগতিশীল ভারত চাই না?”—অরুণ জেটলি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী
মুখ্যমন্ত্রীর এই অনড় মনোভাবকে পরে দলীয় মঞ্চ থেকে বিঁধেছেন জেটলি নিজেই। এ দিনই হাওড়ার শরৎ সদনে দলীয় এক সভায় তিনি প্রশ্ন তোলেন, “শিল্প গড়তে, পরিকাঠামো নির্মাণে এমনকী ঘর তৈরিতেও জমি লাগে। জমি নিতে না দিলে, আমরা থাকব কোথায়? জঙ্গলে? আমরা কি তা হলে আধুনিক, প্রগতিশীল ভারত চাই না?” তাঁর বক্তব্য, “নতুন জমি-আইনে আমরা বাজার দরের চার গুণ দাম দেওয়ার কথা বলছি।” এই সম্মেলনে আসার ঠিক আগে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারেও এই একই কথা বলেছিলেন তিনি।
শিল্পমহলের অনেকে বলছেন, রাজনীতির বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে জমি নিয়ে অবস্থান রাতারাতি বদলে ফেলা হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু শিল্পকে আশা জোগানোর মতো সামান্য নমনীয়তা তো দেখাতে পারতেন তিনি।
সম্মেলনে উপস্থিত এক শিল্পকর্তা বলছিলেন, “জমি ছাড়া যে শিল্প, কল-কারখানা হয় না, তা সকলেই জানেন। আবার এই সরকার যে জমি নেবে না, তা-ও কারও অজানা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, তা হলে এত খরচ করে এমন সম্মেলন আয়োজনের মানে কী?” তাঁর আরও প্রশ্ন, “জমি না-থাকলে, লগ্নি আসবে কেন? আর এলেই বা কারখানা হবে কোথায়?”
সম্মেলনের জন্য ছাপানো পুস্তিকায় রাজ্য ফলাও করে জানিয়েছে, শিল্পের জন্য জমি-ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত জমি মজুত আছে। তা ছাড়া, শিল্পের জন্য ২৪.২ একরের বেশি লাগলে, তা জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনে আটকাবে না। কারণ, ভূমি সংস্কার আইনের ১৪-ওয়াই ধারায় সেই বাড়তি জমি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু শিল্পমহলের অভিযোগ, “শুধু জমি-ব্যাঙ্কের আশ্বাসে তো লগ্নি আসবে না। কোথায় এক লপ্তে বড় জমি আছে, সেখানে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে কি না, আগে তা স্পষ্ট করুক রাজ্য।”আর এক শিল্পকর্তা আবার বলছিলেন, ১৪-ওয়াই ধারায় ছাড়পত্র দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন থাকাটাই বরং সমস্যা। কারণ, সে ক্ষেত্রে বেশি জমির দরকার হলে সরকারি অনুমতির জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হবে। তাঁর প্রশ্ন, “ব্যবসার সুযোগ আইনি ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষা করে কি?” শিল্পমহল তাই চায়, লগ্নির পথ সুগম করতে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিদেন পক্ষে শিথিল করুক রাজ্য সরকার।
এর আগে শহরে এসে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনকে কারও কাজে না-আসা আদিম আইনের তকমা দিয়ে গিয়েছিলেন গোদরেজ গোষ্ঠীর কর্ণধার আদি গোদরেজ। মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলনেও মমতাকে বলেছিলেন, “আপনাদের জমি-নীতিতে শিল্প আদৌ কী ভাবে প্রকল্প তাড়াতাড়ি চালু করতে পারে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।”
তবে আগের মতো এ দিনও শিল্পমহলের উদ্বেগকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনও লক্ষণ দেখাননি মুখ্যমন্ত্রী। বরং স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়েই বলেছেন, স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে বেশি জমি নিয়েছে বন্দর, প্রতিরক্ষা ও রেল। তাদের প্রচুর জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। রেলমন্ত্রী থাকার দরুন তিনি তা জানেন। মমতার দাবি, ওই জমি শিল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করছেন তাঁরা।
এমন নয় যে, জমি নিয়ে নাটকীয় কোনও ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আশা করেছিল শিল্পমহল। কিন্তু বাস্তব সমস্যার কথা ভেবে সামান্য হলেও সুর বদলের আশা করেছিলেন কেউ কেউ। এক শিল্প কর্তার কথায়, “এই মঞ্চ থেকে একটা হাল্কা ইঙ্গিত, একটা ছোট্ট বার্তাও সদর্থক হতে পারত। কিন্তু তা হল কই?”
দেশের অনেক জায়গাতেই জমি নিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে শিল্প। তবে এ রাজ্যে জমি ছোট ভাগে বিভক্ত বলে মালিকের সংখ্যা বেশি। তাই সমস্যাও বেশি। এক শিল্পপতি ঠাট্টা করে বললেন, “এমন পরিস্থিতিতে সরকার যদি জমি নেওয়ার বিষয়ে হাত গুটিয়ে থাকে, তাতে শিল্পেরই লাভ। অন্তত বিনিয়োগ করা কোথায় শক্ত হবে, তা তো গোড়াতেই জানা হয়ে গেল। তা-ই বা কম কী?”