এত দিন ওঁরা বেশির ভাগই ছিলেন ‘মহিলা’, কেউ-কেউ ‘পুরুষ’। হাতে গোনা কিছু ‘অন্যান্য’। সেই ছবিটাই হয়তো এ বার অন্য রকম হতে চলেছে।
হাওড়ার বাঁকড়ায় নিজের বাড়িতে নির্বাচনের কমিশনের প্রতিনিধির কাছ থেকে ভোটার স্লিপ নিচ্ছিলেন দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বৃহন্নলা, যদিও ভোটার স্লিপে তাঁর পরিচয় ‘মহিলা’ হিসাবে। হাত বাড়িয়ে স্লিপ নিয়ে মৃদু হেসে দীপা বললেন, “পরের বার ‘মহিলা’ পরিচয় মুছে ফেলব। নিজের পরিচয়েই ভোট দেব।”
বৃহন্নলা ও রূপান্তরকামীদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেই ছবিটা পাল্টাতে শুরু করেছে। হাওড়ারই জগৎবল্লভপুরের নয়না হিজরা, কেয়া শেখ, আসমিনা হিজরা, সাঁকরাইলের মাসিলার চন্দ্রমুখী শেখ, রেশমা সকলেই তাতে খুশি। তাঁরা প্রত্যেকেই হিজড়ে, যদিও ভোটার তালিকায় পরিচয় রয়েছে ‘মহিলা’ হিসেবে। বছর দুই আগেই ভোটার তালিকায় মহিলা ও পুরুষ ছাড়াও লিঙ্গ-পরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘অন্যান্য’ বলে একটি গোত্র রেখেছে নির্বাচন কমিশন। কিছু হিজড়ে সেই গোত্রে নাম তুলেছেন। তাঁদের যে ভোটার কার্ড দেওয়া হয়েছে তাতেও লিঙ্গের জায়গায় লেখা ‘অন্যান্য’। কিন্তু এঁদের সংখ্যা কার্যত নগণ্য।
নির্বাচন কমিশনের হিসেবে, এ রাজ্যে মোট ভোটার প্রায় সওয়া ৬ কোটি। এর মধ্যে পুরুষ প্রায় সওয়া ৩ কোটি এবং মহিলা প্রায় ৩ কোটি। ‘অন্যান্য’ মাত্র ৫১৩ জন। অথচ হিজড়ে ও রূপান্তরকামীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার দাবি, রাজ্য জুড়ে অন্তত ২০ হাজার প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করতে পেরেছেন যাঁরা ‘অন্যান্য’ হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে পারতেন। এর বাইরেও বহু মানুষ রয়ে গিয়েছেন বলে তাঁদের ধারণা। হিজড়েদের একটি সংগঠন জানিয়েছে, রাজ্য জুড়ে তাদের অন্তত পাঁচ হাজার সদস্য রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের প্রায় সকলের নামই ভোটার তালিকায় রয়েছে মহিলা বা পুরুষ পরিচয়ে। ‘অন্য’ কেউ নেই বললেই চলে।
ওঁরা কোথায়
রাজ্যে মোট ভোটার:
৬,২৪,৬৮,৯৮৮
পুরুষ:
৩,২৪,৮৯,৯৪৯
মহিলা:
২,৯৯,৭৮,৫২৬
অন্যান্য:
৫১৩
ছবিটা এমন কেন?
রূপান্তরকামী ও হিজড়েদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার প্রকল্প অধিকর্তা রঞ্জিতা সিংহের মতে, “এই শ্রেণির মানুষজনকে সামাজিক ভাবে দাবিয়ে রাখা হয়। ফলে অধিকাংশই সামনে আসার সাহস পান না। কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থীই তাঁদের প্রচারে এঁদের কথা তোলেন না। এর পরেও ‘অন্যান্য’ পরিচয়ে যাঁদের নাম উঠেছে, তা একান্ত নিজেদের উদ্যোগেই।” যেমন বেহালার সঞ্জনা রাম। রূপান্তরকামী সঞ্জনা একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ান, সদ্য তালিকায় নাম তুলেছেন ‘অন্যান্য’ ভোটার হিসেবে। তাঁর কথায়, “পুরুষ হিসেবে আমার নাম অনেক দিন আগেই উঠেছিল। বছর দুই আগে নির্বাচন কমিশন ‘অন্যান্য’ ভোটার হিসাবে নাম তোলার সুযোগ দিলে আমি পরিচয় সংশোধন করি।”
কিন্তু বেশির ভাগই তো সুযোগ পেয়েও তা ব্যবহার করেননি?
রূপান্তরকামীদের চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা দেয় এমন একটি সংগঠনের পক্ষে কৌশিক গুপ্তর ব্যাখ্যা, “কেউ যদি নিজেই মহিলা বা পুরুষ হিসাবে পরিচিত হতে চান, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। হয়ত বেশিরভাগ রূপান্তরকামী মহিলা বা পুরুষ পরিচয়ই চেয়েছেন, ‘অন্যান্য’ হিসেবে পরিচিত হতে চাননি।” সঞ্জনা বলেন, “আসলে এতে ঝামেলা অনেক। প্যান কার্ডে বা অন্য নথিতে পুরুষ বা মহিলার বাইরে ‘অন্যান্য’ পরিচয় দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। শুধু ভোটার পরিচয়পত্রে ‘অন্যান্য’ লেখা থাকলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়। তাই অনেকে ভোটার তালিকায় অন্য পরিচয় নিতে চান না।”
তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে এই পরিস্থিতি বদলাবে বলেই মনে করছেন রঞ্জিতা-কৌশিকরা। কেননা, শুধু ভোট নয়, কলেজ-অফিস-ব্যাঙ্ক সর্বক্ষেত্রে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ মান্যতা পেলে বৃহন্নলা তথা রূপান্তরকামীদের পক্ষে নিজের প্রকৃত লিঙ্গ-পরিচয় প্রকাশ্যে আনা সহজতর হবে। প্রান্তিক ‘অন্যান্য’ নয়, বরং নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয়ই সামাজিক সাম্যের দরজাটা আর একটু ফাঁক করে দেবে বলে দীপা-সঞ্জনাদের আশা।