নতুন বছরের প্রথম দিনটিতেই নতুন বোমা ফাটালেন তিনি। নেত্রীর কঠোর নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁকেও ফেলে দিলেন নতুন বিড়ম্বনায়।
তিনি, ডক্টর হাজরা!
দিন কয়েক আগেই বাড়ির ফুলের টব চুরি যাওয়ায় জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। পরের একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘বেটার আই শু্যড ফোকাস অন মাই টিচিং অ্যান্ড স্টাডি’! বুধবার সন্ধ্যায় ফেসবুকেই ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বোলপুরের তরুণ সাংসদ অনুপম হাজরা লিখলেন ‘...বেস্ট উইশেস ফর দেম অলসো হু ভোটেড এগেনস্ট মি! ...উইশিং বীরভূম ডিস্ট্রিক্ট এ পিসফুল ইয়ার অ্যাহেড!!!... সেলিব্রেটিং নিউ ইয়ার... ইগনোরিং দ্য সাফোকেশন অব বিয়িং অ্যান এমপি... ট্রুলি ইন মাই ওন ওয়ে!’
সাংসদ হয়েছেন এক বছরও হয়নি। এখনই কেন এত ‘দমবন্ধ’ লাগছে? অনুপমের ফেসবুক পোস্ট দেখেই ঝড় উঠেছে সর্বত্র। যোগাযোগ করা হলে অনুপম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও এক জন এলাকার সাংসদ হয়ে উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে বারবার মতের ফারাক হচ্ছে। কী করে উন্নয়নের কাজ করব?” প্রায় আক্ষেপের সুরে তাঁর আরও মন্তব্য, “সাংসদ হয়ে ব্যক্তি-জীবন বলে কিছু নেই আর। পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মতো সময় কাটাতে পারি না। দমবন্ধ হয়ে আসে।” সেই সঙ্গেই বলেছেন, “পোড় খাওয়া রাজনীতির নেতা নই। হয়তো আমিই রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না! তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই রাজনীতিতে এসেছিলাম।”
তাল মেলাতে পারছেন না তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও। বোলপুরের সাংসদের নবতম ফেসবুক পোস্টের খবর পৌঁছেছে দলের নেতৃত্বের কানেও। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “অনুপমকে ডেকে জানতে চাওয়া হবে, কেন বারবার এমন মন্তব্য করতে হচ্ছে? বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গেও কথা বলেছি। কোথায় সমস্যা, তা নিয়ে জেলা সভাপতিও সাংসদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।” তবে তৃণমূলেরই এক সাংসদের বক্তব্য, ঘরোয়া আলাপচারিতায় নানা সময়েই দলের, বিশেষত অনুব্রত-বিরোধী কথাবার্তা শোনা যায় অনুপমের মুখে। দিল্লিতে কোনও কোনও চা-চক্রের আসরে তাঁর মুখে নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসাও শোনা গিয়েছে! দলের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “রাজনীতির বাইরে থেকে আসা লোকেদের নিয়ে এই সমস্যা! অনুপমদের বয়স কম, ধৈর্যও কম। যখন তখন মাথা খারাপ হয়!”
কী বলছেন অনুব্রত?
তাঁর বক্তব্য, “সাংসদের উন্নয়ন বলতে তো সাংসদ কোটার টাকাই আছে। এখনও পর্যন্ত অনুপম আড়াই কোটি টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা ৭টা বিধানসভায় ভাগ করা হয়েছে বলে শুনেছি। এর বাইরে কী উন্নয়নের কথা উনি বলছেন জানি না!” দলে অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য বলছে, অনুপম জেতার পরে জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেননি। দিল্লি-কলকাতা করেই তাঁর সময় কেটে যায়! নিজের এলাকায় ৭টি বিধানসভার একটিতেও যাননি। দলের তরফে এখন তাই অনুপমকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে বলা হচ্ছে। তাতে তিনি নাকি রাজি নন! দলের ওই অংশের দাবি, “এর মধ্যে উন্নয়ন-অনুন্নয়নের প্রশ্ন এল কোথা থেকে!”
একই রকম বিস্ময়ের ঢেউ উঠেছে ফেসবুকে। নতুন বছরের শুভেচ্ছা-বার্তার সঙ্গে কলকাতায় তোলা তাঁর নিজের একটি ছবিও পোস্ট করেছেন সাংসদ। যাতে তাঁকে রিকশা টানতে দেখা যাচ্ছে। সাংসদের প্যাডেল রিকশা টানার ছবি দেখে তাঁর এক বন্ধুর রসিকতা, “টোটো রিকশার যুগে সাইকেল রিকশা মিসম্যাচ!” যদিও অনুপমের এ বারের পোস্ট রসিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক দূর।
পরপর তাঁর এমন জ্বালাময়ী পোস্ট দেখে কারও কারও প্রশ্ন সুগত বসু, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে (প্রসঙ্গ, সারদা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)-দের মতোই কি বাজারে কথা ছেড়ে ‘জল মাপতে’ চাইছেন বিশ্বভারতীর সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক-সাংসদ অনুপম? তাঁর ঘনিষ্ঠমহল অবশ্য বলছে, জেলার তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে এলাকার নানা উন্নয়ন কাজের গুরুত্ব নিয়ে অনুপমের প্রথম থেকেই মতের অমিল দেখা দিয়েছে। সাংসদ দিল্লিতে ঘনিষ্ঠ মহলে সে নিয়ে মৃদু অনুযোগও করেছেন। ঘটনা হল, বীরভূমে উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে প্রথম বার সাংসদ হয়ে শতাব্দী রায়ও সিউড়ি পুরসভায় একটি অ্যাম্বুল্যান্স দিতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলেন তৃণমূল কাউন্সিলরের কাছে। অনুপমের ঘনিষ্ঠমহলের দাবি, একই অভিজ্ঞতার শিকার তিনি।
জেলা বিজেপির সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের তির্যক মন্তব্য, “যে দল উন্নয়নই করে না, তার সাংসদ হয়ে এ সব বলে সাধু সাজতে চাইছেন অনুপমবাবু! এ সবের পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে!”
তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য যা বোঝার বুঝেই নিয়েছেন বিবেকের তাড়নায় জেগে উঠছেন ‘হাজার হাজার ডক্টর হাজরা’।
গণ্ডগোল, বিস্তর গণ্ডগোল!