সাধারণ ঘরের এক অতি সাধারণ মেয়ে। যদিও তাঁর কাহিনি আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়।
বিয়ে মাত্র ষোলো বছর বয়সে। বর্ধমানের ছেলের সঙ্গে। ব্যারাকপুরে নোনাচন্দনপুরের বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর হাত ধরে কিশোরী বধূ এসে উঠেছিলেন কলকাতার রাজারহাটে। তার পরে ভাগ্য অন্বেষণের আশায় নবদম্পতির মুম্বই পাড়ি। কিন্তু ভাগ্য সেখানে সঙ্গ দেয়নি। স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে বাণিজ্য-রাজধানীতে নতুন জীবন শুরু করা, পাকে-চক্রে অপরাধ জগতে জড়িয়ে দুবাই-যাত্রা, দেশ কাঁপানো অপহরণ-মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতারি এবং রাজসাক্ষী হওয়ার সুবাদে রেহাই পেয়ে আবার সুস্থ জীবনে ফিরে আসা গত দেড় দশকের জীবনপথে উথালপাথালের একটা মুহূর্তও বিবর্ণ হয়ে যায়নি স্বাতী পালের স্মৃতির খাতা থেকে।
স্বাতী পাল। তেরো বছর আগে খাদিম-কর্তা অপহরণের তদন্ত চলাকালীন ‘শিরোনামে’ থাকা গায়িকা-নর্তকী সোমবার আবার নজরের কেন্দ্রে। এ দিন যিনি আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বিশেষ কোর্টে মামলার রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে উঠে নিজের জীবনের ওই অন্ধকার অধ্যায়টির দিকেই ফিরে তাকালেন। পরনে সবুজ-লাল বুটিদার চন্দন রঙের শাড়ি। প্রসাধনের বালাই নেই। একদা মুম্বই-দুবাইয়ের ‘আন্ডার ওয়ার্ল্ড’ দাপিয়ে বেড়ানো মেয়ের গলা সাক্ষ্য দিতে উঠে এক বারও কাঁপল না। অকপটে বলে গেলেন, কী ভাবে স্বামীই তাঁকে ঠেলে দিয়েছিলেন অকূলপাথারে। পরে কী ভাবে নাচ-গানের সুবাদে অপরাধ জগতের মানুষজনের সঙ্গে পরিচয়। আর শেষে দুবাই গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ-চক্রে জড়িয়ে পড়া।
মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে কলকাতার তিলজলায় খাদিম-কর্তা পার্থসারথি রায়বর্মণকে অপহরণের অভিযোগে অন্য বাইশ জনের সঙ্গে স্বাতীকে গ্রেফতার করেছিল সিআইডি। পরে রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে সিআইডি চার্জশিট পেশ করেনি। মূলত তাঁরই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বছর পাঁচেক আগে খাদিম-মামলায় আফতাব আনসারি-সহ পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ধৃত আরও সাত অভিযুক্তের (আসলাম খান, দিলশাদ, নঈম, মোজাম্মেল শেখ, শেখ মিজানুর, আখতার মৌলানা ও নূর মহম্মদ শাহবাজ) বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এ দিন তাঁকে তলব করা হয় বিশেষ আদালতের বিচারক কাজী সফিউর রহমানের এজলাসে।
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে তৈরি হওয়া বিশেষ কোর্টের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাতী যখন তাঁর কাহিনি জানাচ্ছেন, তখন আদালতের জালে ঘেরা কাঠগড়া থেকে তাঁর দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে সাত অভিযুক্ত। যাদের অনেকের সঙ্গেই এক সময় স্বাতীর ওঠা-বসা, দহরম-মহরম ছিল। কিন্তু ওদের মামলা এত দিন পরে উঠল কেন?
কে এই স্বাতী
সিআইডি-সূত্রের খবর: তিন পাক নাগরিক আসলাম খান, দিলশাদ ওনঈম-সহ এদের পাঁচ জন ভিন রাজ্যে বিচারাধীন থাকায় তখন তাদের কলকাতায় আনা যায়নি। আর মিজানুরকে সদ্য গত বছর গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স। মোজাম্মেলকেও সম্প্রতি হাতে পেয়েছে সিআইডি। বিশেষ সরকারি আইনজীবী নবকুমার ঘোষ এ দিন আদালতের বাইরে বলেন, “খাদিম-মামলার দ্বিতীয় পর্যায়ের বিচার শুরু হয়েছে। তাই স্বাতী পালের সাক্ষ্যের প্রয়োজন ছিল।”
সেই সাক্ষ্যেই বেরিয়ে এল স্বাতীর জীবনের টানাপড়েনের নানা ছবি। দুবাই গিয়ে কী ভাবে অত্যাচারের শিকার হলেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাক্ষীর চোখ ছলছল করে উঠল। জানালেন, দুবাইয়ের এক হোটেলে তিনি গান গাইতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করার জন্য চাপ আসতে থাকে। প্রতিবাদ করলেই জুটত শারীরিক নিগ্রহ। এমনই এক সময়ে আবদুর রহমানের সঙ্গে স্বাতীর ঘনিষ্ঠতা, যে কি না তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল নিজের ‘বস’ ফারহান মালিক ওরফে রাজুভাই-এর কাছে। পুলিশের দাবি, রাজু ভাই-ই আদতে আফতাব আনসারি।
রাজু ভাই আর আবদুর করতোটা কী? স্বাতী সাক্ষ্যে বলেন, দু’জনেরই কাজ ছিল ফোনে লোকজনকে হুমকি দিয়ে টাকা আদায়। ২০০১-এর মার্চে রাজুভাই হঠাৎ পাকিস্তান চলে যায়। সেখান থেকে সে নিয়মিত আবদুরকে ফোন করত। স্বাতীর দাবি, তেমনই একটা ফোন থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, কলকাতার কাউকে গুম করার ছক হচ্ছে। স্বাতী জানান, এর পরেই তাঁর কলকাতার বাড়িতে ফোন করা বন্ধ হয়ে যায়। বাইরের লোকের সঙ্গেও যোগাযোগে ইতি টানতে হয়। ২০০১-এর জুলাইয়ে তিনি মুম্বই ফেরেন। তার ক’দিনের মধ্যে অপহৃত হন খাদিম-কর্তা।
তদন্তে নেমে মুম্বইয়ের এক হোটেলে পুলিশ স্বাতীকে গ্রেফতার করে। তাঁর সঙ্গে ধরা পড়ে আবদুর, যাকে অপহরণ-চক্রান্তের অন্যতম মাথা হিসেবে সিআইডি চিহ্নিত করেছে এবং আফতাবদের সঙ্গেই যার যাবজ্জীবন হয়েছে। কী ভাবে পুলিশ তাঁদের ধরল, কাল বুধবার বিশেষ আদালতে সেই বৃত্তান্ত শোনাবেন খাদিম-মামলার মূল রাজসাক্ষী।
এখন কেমন ভাবে কাটছে?
আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে স্বাতী মৃদু হাসলেন। বললেন, “জলসায় গান গাই। যাত্রাও করি।” পুরনো দিনের কথা ভাবলে কিছু মনে হয় না?
“দুঃখ হয়।” অকপট উত্তর। তাতে মিশে থাকে আক্ষেপও। বলেন, “এ দিন যখন কোর্টে আসছিলাম, পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম, ভাগ্যের ফেরে কোথায় গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিলাম!” ভাগ্যের ফের পুরো কেটেছে কি না, সে সম্পর্কে অবশ্য নিশ্চিত নন। “সমাজের অনেকে, এমনকী পাড়া-পড়শিদের কেউ কেউ এখনও আমায় অপরাধী হিসেবে দেখেন! জানি না, জীবদ্দশায় দাগটা মুছবে কি না!”
গলা ভারী হয়ে আসে স্বাতী পালের।