এক ছাত্র ২০১২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। ২০১৬-য় তিনি নাম ভাঁড়িয়ে আবার পরীক্ষা দিলেন। এবং আবারও পাশ করে গেলেন! কিছুই টের পেল না ওই পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক পর্ষদ। তাদের সৌজন্যেই তিনি ‘ডবল মাধ্যমিক’! কিন্তু নম্বরে তুষ্ট নন!!
গল্প নয়। ঘোর বাস্তব। রহস্যময় বাস্তব। রহস্যময়, কেননা রহস্য এই পরীক্ষা-বৈতরণীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে। রহস্যের নায়ক যিনি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নজরদারির হাল দেখে স্বয়ং সেই ছাত্রটিও রহস্যে চমৎকৃত। কেননা, প্রথম বারের পরীক্ষায় একটি বিষয়ে পাঁচ নম্বর প্রশ্নের উত্তর লিখেই তিনি বেমালুম পাশ করে যান! দ্বিতীয় বার অন্য একটি বিষয়ের খাতা জমা না-দিয়েই তিনি সসম্মান উত্তীর্ণ। যদিও ছাত্রটির দাবি, প্রতি বারেই তাঁর আরও বেশি নম্বর পাওয়ার কথা!!
পরীক্ষায় টোকাটুকি, টাকা নিয়ে অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া— অনেক রকম জালিয়াতির কথা শোনা যায় ফি-বছর। কিন্তু এক ছাত্র কী ভাবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক বার পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে চলেছেন, সেই প্রশ্ন তুলছে শিক্ষা শিবির। চার বছরেও মধ্যশিক্ষা পর্ষদ জানতেই পারেনি এই জালিয়াতির কথা। এবং পরীক্ষা-জালিয়াতির অভিনবত্ব এখানেই শেষ হচ্ছে না।
পুলিশি সূত্রের খবর, দ্বিতীয় বারের ফলাফলে খুশি না-হওয়ায় সম্প্রতি সেই ছাত্র (এখন রীতিমতো যুবক) মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার আইনে উত্তরপত্র দেখা) করার কথা জানান। কথায় কথায় পর্ষদ-প্রধানের সামনেই ছাত্রটি বলে ফেলেন, প্রথম বারের পরীক্ষায় ইংরেজি খাতায় তিনি মাত্র পাঁচ নম্বরের উত্তর লিখেছিলেন। এবং দ্বিতীয় বার জীবনবিজ্ঞানের উত্তরপত্র জমাই দেননি!
শুনে সন্দেহ হয় কল্যাণময়বাবুর। বিধাননগর-পূর্ব থানায় অভিযোগ করা হয়। অর্থাৎ ছাত্রটি কার্যত নিজেই ধরা দেন। বৃহস্পতিবার ওই যুবককে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর পূর্ব থানার পুলিশ। ধৃতের নাম সুমন মণ্ডল। নিবাস নদিয়ার হাঁসখালি। তাঁকে সাত দিন পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে বিধাননগর আদালত।
পুলিশ জানায়, জেরায় জানা গিয়েছে, নাম ভাঁড়িয়ে দু’বার পরীক্ষা দিয়েছেন সুমন। ২০১২ সালে নিজের নামে এবং ২০১৬-য় অয়ন মণ্ডল নামে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। দ্বিতীয় বার পরীক্ষার ফল হাতে পেয়ে তিনি খাতা দেখতে চেয়ে আবেদন করেন। তখনই গোলমাল ধরা পড়ে। জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে সুমনের বিরুদ্ধে।
একই ছাত্র দু’বার ভিন্ন নামে পরীক্ষা দিলেন। অথচ পর্ষদ সেটা টের পেল না কেন? সুমন যদি খাতা দেখার আবেদন না-করতেন, তা হলে হয়তো কোনও দিনই ব্যাপারটা টের পেত না পর্ষদ! তার থেকেও বড় কথা, ইংরেজির মতো বিষয়ে যে-পরীক্ষার্থী মাত্র পাঁচ নম্বরের উত্তর লেখেন, তিনি পাশ করেন কী ভাবে? কী ভাবে এমন একটি ছাত্র পাশ করতে পারেন, যিনি জীবনবিজ্ঞানের খাতা জমাই দেননি?
তদন্তকারীরা জানান, কেন এই জালিয়াতি ধরা পড়ল না, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তকারীদের একটি অংশের বক্তব্য, ওই যুবকের বক্তব্য কতটা ঠিক, তা যাচাই করা দরকার। পর্ষদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু তিনি যে দু’-দু’বার পরীক্ষা দিয়ে ‘উত্তীর্ণ’ হয়েছেন, তাতে কোনও ভুল নেই।
আর এখানেই প্রশ্ন উঠেছে সার্বিক ভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষা, ছাত্রছাত্রীদের উত্তরপত্রের বিচার এবং ফলাফল-সহ গোটা প্রক্রিয়া নিয়ে। শিক্ষাজগতের একাংশের বক্তব্য, ভূত রয়েছে সর্ষের মধ্যেই। পুলিশ তদন্ত করে বার করুক। এর পিছনে বড়সড় কোনও চক্র থাকলেও থাকতে পারে।
বিধাননগরের গোয়েন্দা-প্রধান সন্তোষ পাণ্ডে জানান, ছাত্রটি কেন দু’বার পরীক্ষা দিলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কী ভাবেই বা তিনি নথিপত্র জাল করেন, তা-ও দেখা হচ্ছে।
পর্ষদের বক্তব্য, এমন জালিয়াতি তাদের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। কারণ, কয়েক বছর অন্তর দু’জন পরীক্ষার্থীর অ্যাডমিট কার্ডের নম্বর এক হতেও পারে। তবে যা কখনওই এক হবে না, তা হল রেজিস্ট্রেশন নম্বর। অভিযুক্ত যুবক প্রথম যে-স্কুল থেকে পরীক্ষা দেন, সেখানে তিনি জন্ম-তারিখের নথি এবং অন্য কাগজপত্র ঠিকঠাকই জমা দেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার যে-স্কুল থেকে পরীক্ষা দেন, সেখানে নাম বদলে ফেলেন। অন্যান্য তথ্যও জাল করা হয়েছে বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। ফলে তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বরও বদলে যায়। সেই জন্যই বিষয়টি পর্ষদের নজরে পড়েনি। কল্যাণময়বাবুর সঙ্গে দেখা করে ছাত্রটি আরটিআইয়ের আবেদন জানানোর পরেই সন্দেহ জাগে। কল্যাণময়বাবু বলেন, ‘‘ওই দুই স্কুলের কর্তৃপক্ষকেই ডেকে পাঠানো হয়েছে। সব তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে দুই প্রধান শিক্ষককে।’’