কর্মশালায় তিলাবনির স্কুলের পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।
এত দিনের ধারণাটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছিল ওদের। বছর চোদ্দো-পনেরোর ওই কিশোরীগুলো এত বছর ধরে জানত, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে না হলে পরিবারের লজ্জা। কিন্তু স্কুলের কর্মশালায় জানল, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াটাই লজ্জার বিষয়, সামাজিক অপরাধও। সম্প্রতি ঝাড়গ্রামের ‘সুচেতনা’ মহিলা সংগঠনের উদ্যোগে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পশ্চিম মেদিনীপুরের তিলাবনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে আয়োজন করা হয়েছিল একটি কর্মশালার। সেখানে এত বছরের জানা আর নতুন এই জানার দ্বন্দ্বে কর্মশালা চলাকালীন পাক্কা আড়াই ঘন্টা একেবারে পিছনের সারিতে মাথা নিচু করে নিজেদের আড়ালেই রাখল টিয়া ও চন্দনা-রা (নাম পরিবর্তিত)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের তিলাবনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়তে আসে তিলাবনি-সহ আশেপাশের ১৫টি গ্রামের ছেলেমেয়েরা। স্কুলের ১,১৮৭ জন পড়ুয়ার মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ৬১৬ জন। স্কুলের ২৯২ জন ছাত্রী কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও টিয়া-চন্দরাদের মতো নাবালিকাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, নবম শ্রেণির টিয়ার (নাম পরিবর্তিত) মূর্চ্ছারোগ ছিল। প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে ঝাড়গ্রামে এক মহিলা চিকিত্সকের কাছে টিয়ার চিকিত্সা করাচ্ছিলেন অভিভাবকরা। হঠাত্ টানা কয়েক দিন স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল মেয়েটি। তারপর একদিন সে আবার স্কুলে এল, তবে সিঁদুর পরে। গালভরা হেসে টিয়ার বাবা প্রধান শিক্ষককে জানিয়েছিলেন, মেয়েকে ভূতে ধরেছিল। জানগুরুর নিদানে বিয়ের পর ভূত নেমে গিয়েছে। টিয়া এখনও পড়াশুনো করছে। তবে কতদিন সে স্কুলে আসবে তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের লালগড় ব্লকের পাশাপাশি, বেলপাহাড়ি, জামবনি, গোপীবল্লভপুর-১ ও সাঁকরাইল ব্লকে বাল্যবিবাহের সমস্যা প্রবল। ২০১৪ সালে প্রশাসনের সহযোগিতায় ৯৭ জন নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায়, আরও কত টিয়া-চন্দনারা অসময়ে বিয়ের খাঁচাবন্দি হওয়ার খবর অজানাই থেকে যায়। কিন্তু এই আধুনিক যুগে এখনও সেই বাল্যবিবাহের অভিশাপ কেন বয়ে চলেছে এই নাবালিকারা?
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানাচ্ছেন, এর প্রধান কারণ যেমন প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস। কম বয়সে মেয়েকে পাত্রস্থ না করলে সমাজে মাথা হেঁট হয়ে যায় অভিভাবকদের। সেই সঙ্গে কন্যাসন্তানকে শেখানো হয়, সে বাবা-মায়ের দায়। কোনও ভাবেই এই কুপ্রথাকে ঠেকানো যাচ্ছে না তা কবুল করছেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তিলাবনি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীপকুমার মণ্ডলের আক্ষেপ, “কিছুতেই অভিভাবকদের বুঝিয়ে নিরস্ত করা যাচ্ছে না। আমাদের স্কুলে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের স্কুলছুটের সংখ্যাটা বেশি।” কর্মশালায় ছাত্রীদের প্রশ্ন করা হয়, ‘তোমরা বাবা-মায়ের কাছে সত্যিই কী দায়’? সমস্বরে জবাব আসে, ‘হ্যাঁ।’ কেন কন্যা-দায়? সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য তাদের অজানা।
কর্মশালায় আসা দীপ্তি, ফুলমণি, শিশুমতি, সুপ্রিয়া, গোলাপ, দীপ্তিরা জানায়, বিয়ে নয়, তারা লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তাদের অসম প্রতিবাদ আদৌ কী সম্ভব? নিজেদের কিংবা কোনও সহপাঠিনীর কম বয়সে বিয়ে ঠেকানোর মতো শক্তি কোথায় তাদের? মেদিনীপুর আদালতের প্রবীণ আইনজীবী রঘুনাথ ভট্টাচার্য চাইল্ড লাইনের টোল ফ্রি নম্বর দেন ছাত্রীদের। জানান, পরিচয় গোপন রেখে শুধু খবর দিলেই হবে। লালগড় থানার সাব ইন্সপেক্টর সুজন রায় পড়ুয়াদের জানান, কীভাবে বিয়ের নামে অনেক মেয়েকেই হারিয়ে যেতে হয়েছে ভিন রাজ্যের অন্ধকার জগতে। কম বয়সে শরীর ও মন বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়, সেটা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে পড়ুয়ারা শিখেছে বটে। কিন্তু পাশে থেকে প্রতিবাদের কথা তেমন করে তো আগে কেউই বলেন নি। কর্মশালার মূল বক্তা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সচিব তথা বিচারক অজয়েন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “এই সংস্কারের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য প্রতিটি কর্মশালায় প্রশ্নোত্তর পর্বটা খুবই জরুরি। এতে সচেতনতার কাজটা আরও সহজে হয়।”
বাল্যবিবাহ ঠেকাতে সর্বভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অ্যাকশন এড অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডিয়া’র সহযোগিতায় ও ‘সুচেতনা’ মহিলা সংগঠনের উদ্যোগে জঙ্গলমহলের গ্রামে গ্রামে নজরদারি চালানোর জন্য টিম লিডার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ‘সুচেতনা’-র সম্পাদক সমাজকর্মী স্বাতী দত্ত বলেন, “বাল্যবিবাহের শিকড়টা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আরও গভীর হচ্ছে। আমাদের লড়াইটাও আরও কঠিন হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, কেবলমাত্র এক দিনের কর্মশালা নয়। পর্যায়ক্রমে সারা বছর জুড়ে জঙ্গলমহলের স্কুলগুলিতে গিয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ‘মনের জোর’ বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। টিম লিডার-রা প্রতিটি গ্রামে দল গড়ে পাড়া বৈঠক করে অভিভাবকদের সচেতন করছেন। সাফল্য কিছু আসছে, তবে তা সিন্ধুতে বিন্দুবত্।
সব শেষে ছাত্রীদের একটি গল্প বলেন বিচারক। ষোলো বছরের এক নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে গেলে মেয়েটি নিজেই পুলিশকে জানায় যে, সে স্বেচ্ছায় বিয়ে করছে। বিচারক ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে জানতে চান, “এ ক্ষেত্রে পুলিশ কী করবে? হাত গুটিয়ে কী ফিরে আসবে?” সমস্বরে চিত্কার করে সামনের সারির ছাত্রীরা জবাব দেয়, “পুলিশকে ওই বিয়ে বন্ধ করতে হবে। মেয়েটির বাবা-মাকে পুলিশ আটক করবে। যারা নিমন্ত্রণ খেতে এসেছিল, তাদেরও পুলিশ ধরবে।”
এতক্ষণ শ্রোতার আসনে চুপ করে থাকা ছাত্ররা এ বার সমস্বরে বলে ওঠে ‘বেটি জিন্দাবাজ’! বাইরে তখন কালবৈশাখী শুরু হয়ে গিয়েছে।