বায়ু দূষণে জেরবার পাকিস্তান। একরকম শ্বাস আটকে যাওয়ার দশা পশ্চিমের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরের। এই পরিস্থিতিতে দূষণের মাত্রা কমানোর চেষ্টা দূরে থাক, উল্টে ভারতের ঘাড়ে দোষা চাপাতে ব্যস্ত ইসলামাবাদ। নয়াদিল্লিকেই ‘যত নষ্টের গোড়া’ বলে দাবি করেছেন পাক রাজনীতিবিদেরা।
পাক শহরগুলির মধ্যে লাহোরে দূষণের মাত্রা সর্বাধিক। গত কয়েক দিন ধরেই ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে রয়েছে দেশটির এক সময়কার রাজধানী। নভেম্বরের প্রথম রবিবার সেখানকার ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ হাজার ছাড়িয়ে যায়। যা রেকর্ড। বিষ-বাতাসে গোটা এলাকা ভরে যাওয়ায় মৃত্যুর আশঙ্কাও বাড়ছে।
বাতাসের গুণগত মান পরিমাপের একক হল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই। যা ৪৫০ ছাড়ালে দূষণের মাত্রা ‘অতি ভয়ানক’ বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বা চোখ জ্বালার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যা লাহোরে ভয়াবহ আকার নিচ্ছে বলে পাক সংবাদমাধ্যমগুলি থেকে জানা গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে এক সপ্তাহের জন্য সমস্ত প্রাথমিক স্কুল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে লাহোর প্রশাসন। পাশাপাশি, নাগরিকদের সর্বক্ষণের জন্য মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। লাহোরের জনসংখ্যা ১ কোটি ৪০ লক্ষ। তাঁদের জীবনরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে দাবি করেছেন পাক সরকারি আধিকারিকেরা।
পাশাপাশি, সরকারি দফতরগুলিতে ‘সবুজ লকডাউন’ জারি করেছে লাহোর প্রশাসন। যাতে ৫০ শতাংশ কর্মচারীকে বাড়ি থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ফিল্টারবিহীন বারবিকিউ খাবার, মোটরচালিত রিকশা এবং রাত ১০টার পর বিয়েবাড়ি পুরোপুরি বন্ধ রাখার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে লাহোর প্রশাসন। বাজি পোড়ানোর উপরেও রয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা।
লাহোরের এক সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন, বিষ-বাতাসে গোটা শহর ঢেকে যাওয়ায় অসুস্থতার পরিমাণ হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কয়েক হাজার বাসিন্দা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁদের সিংহভাগই বয়স্ক ও শিশু। ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গত হয়, এমন যানবাহন নিয়ে রাস্তায় বার হলে জারিমানা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের পরিবেশ সুরক্ষা দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাতাসে অতি ক্ষুদ্র ধূলিকণার ঘনত্ব (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) ৪৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। যা মারাত্মক বিপজ্জনক। এর জন্য অপরিকল্পিত ভাবে সবুজ ধ্বংসকে দায়ী করেছে তারা। দ্রুত নগরায়নের জন্য সেখানকার বহু পার্কও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। যার বাতাষে বিষের পরিমাণ চড়চড়িয়ে বেড়েছে।
লাহোরের এই বায়ুদূষণের জন্য ভারতকে এক হাত নিয়েছেন পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ়। সম্পর্কে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফের মেয়ে। ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়’-এর শীর্ষ নেত্রী বলেছেন, ‘‘লাহোরের বিষ-বাতাস আসছে ভারত থেকে। এর জন্য পুরোপুরি দায়ী অমৃতসর ও চণ্ডীগড়।’’ যা অবিলম্বে বন্ধ না হলে, চুপ করে থাকবেন না বলে একরকম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
গত ৩ নভেম্বর এই বিষয়ে মুখ খোলেন মরিয়ম সরকারের পরিবেশমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজ়েব। জনপ্রিয় পাক সংবাদমাধ্যম ‘ডন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় শহর অমৃতসর ও চণ্ডীগড় থেকে যে বিষ-বাতাস লাহোরে ঢুকছে, তাতেই বাতাসের একিউআইয়ের সূচককে হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে।’’ পরিস্থিতি সামলাতে কৃত্রিম বৃষ্টির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নভেম্বরেও পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার যে তেমন সম্ভাবনা নেই, তা একরকম স্বীকার করে নিয়েছে লাহোর প্রশাসন। ‘‘আমরা ভারতীয় কর্মকর্তাদের চিঠি লিখছি। বিষয়টি তাঁদের জানিয়েছি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র সদর্থক ভূমিকা না নিলে পরিস্থিতি বদলের সম্ভাবনা নেই।’’ ডনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন মরিয়ম আওরঙ্গজেব।
অন্য দিকে, এই ইস্যুতে মরিয়ম নওয়াজ় বলেছেন, ‘‘ধোঁয়াশা ও দূষণের সমস্যাটা ভারত ও পাকিস্তান দু’দিকের পঞ্জাবেই রয়েছে। ফলে রাজনীতিকে সরিয়ে রেখে এর সঙ্গে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করতে হবে। এটা আমজনতার স্বাস্থ্যের প্রশ্ন। সেটা ভাল রাখা আমাদের কর্তব্য।’’ পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মানকে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে লাহোরের কপালে জুটেছে বিশ্বের দূষিততম শহরের তকমা। এ বছরের ২ নভেম্বর একদা পাকিস্তানের রাজধানী শহরের একিউআইয়ের মাত্রা দাঁড়ায় ১৯০০। তার পরই বিশেষ পরামর্শ বিজ্ঞপ্তি (অ্যাডভাইসরি) জারি করে পাক প্রশাসন। তাতে নাগরিকদের অধিকাংশ সময়ে বাড়ির ভিতরে থাকতে বলা হয়েছে।
লাহোরের মতো দূষণের সমস্যা রয়েছে দিল্লিরও। ফি বছর শীত এলেই ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে রাজধানী। তাপমাত্রা কমলে বাতাসের অতি ক্ষুদ্র কণার কিছু অংশ মাটির কাছাকাছি চলে আসে। এর সঙ্গে কুয়াশা মিশলে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। যা জেরে শ্বাস জনিত সমস্যায় ভুগতে থাকেন এলাকাবাসীরা।
লাহোরের দূষণ ঠেকাতে নয়াদিল্লি হাত বাড়িয়ে দেবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। সীমান্ত পার সন্ত্রাসবাদের জেরে দু’দেশের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। অক্টোবরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’র বৈঠকে যোগ দিতে পাক সফরে যান বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। কিন্তু সেখানে ইসলামাবাদের সঙ্গে কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেননি তিনি। ফলে লাহোরের দূষণ নিয়ে পাকিস্তানের আক্রমণের জবাব নয়াদিল্লি আদৌ দেবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞ মহল।