প্রতীকী ছবি।
ঘন ঘন বোমার শব্দ, রে রে করে চিৎকার, লাঠি হাতে কখনও জনতার দিকে তে়ড়ে যাচ্ছে পুলিশ-র্যাফ-কমব্যাট ফোর্সের জওয়ানেরা, কখনও জনতার ছোড়া ইটের থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ব্যস্ত তারা।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে ভয়ে জড়োসড়ো ছয় মহিলা কনস্টেবল। গুলি-বন্দুক-কাঁদানে গ্যাসের সেল তো দূরের কথা, একখানা লাঠিও নেই হাতে।
মঙ্গলবার তখন বিকেল প্রায় সাড়ে ৪টে। ভাঙড়ের বাদামতলায়, পাওয়ার গ্রিড থেকে খানিক দূরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। আর পিছনে পড়ে থাকা ছয় মহিলা পুলিশ কর্মী ভাবছেন, কী ভাবে রক্ষা পাবেন নিজেরা। তার আগে খবর রটে গিয়েছে, পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন দুই গ্রামবাসী। বাড়ি বাড়ি ঢুকে পুলিশ গ্রামবাসীদের পিটিয়েছে, হুমকি দিয়েছে বলেও খবর ঘুরছে লোকের মুখে মুখে। দফায় দফায় জনতা-পুলিশ সংঘর্ষে উত্তাল পরিস্থিতি।
ছয় মহিলা পুলিশ কর্মী বুঝে নেন, এই পরিস্থিতিতে সহকর্মীদের দিকে এগোতে গেলে আরও বিপদ। বাঁচতে গেলে অন্য পথ ধরতে হবে।
সেই মতো উল্টো দিকে উড়িয়াপাড়া-গাজিপুরের পথ ধরেন সকলে। কখনও হেঁটে, কখনও ছুটে, কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে ফের উঠে কোনও মতে ঢুকে পড়েন গ্রামের ভিতরে। আশপাশের পরিস্থিতি দেখে বুঝে নেন, গ্রাম তখন কার্যত পুরুষশূন্য। বাড়ির ছেলেরা সকলে পুলিশ খেদাতে ব্যস্ত।
সামনের একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েন ছয় মহিলা পুলিশ কর্মী। পুলিশ দেখে হতভম্ব বাড়ির মেয়ে-বৌরাও। কিন্তু এই পুলিশের সেই রোয়াব কই, বরং নিজেরাই আশ্রয় চাইছেন।
গ্রামের এক মহিলার কথায়, ‘‘ওদের তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। পোশাক অগোছালো। শীতের বিকেলেও ঘেমেনেয়ে একসা।’’
যে পুলিশের বিরুদ্ধে এত রাগ জমেছে গ্রামের লোকের, তাঁদের মুখে প্রাণভিক্ষার আর্জি শুনে গ্রামের মেয়ে-বৌরা হকচকিয়ে যান। কিন্তু ঠিক করে ফেলেন, পুলিশের উর্দি গায়ে থাকলেও এরা তো আসলে তাদের মতো মহিলাই। মেয়ে হয়ে মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোই এখন কর্তব্য।
সেইমতো মহিলা পুলিশ কর্মীদের জল দেওয়া হয়। আশ্বাস মেলে, কোনও চিন্তা নেই। এখানে আপনাদের কোনও ক্ষতি কেউ করবে না।
এক মহিলা কনস্টেবলের মাথায় বুদ্ধি খেলে, নিরাপদে গ্রাম ছাড়তে গেলে পোশাক বদলানো জরুরি। ঠিক হয়, পুলিশের খাকি উর্দি বদলে ফেলবেন সকলে। পাঁচজনের ব্যাগে শালোয়ার-কামিজ, শাড়ি ছিল। কিন্তু বারুইপুর থানার এক মহিলা কনস্টেবলের কাছে সাদা পোশাক নেই। তিনি গ্রামের এক মহিলাকে ডেকে বলেন, ‘‘দিদি, আমাকে যা হোক একখানা কাপড় দিতে পারেন।’’
জানা গিয়েছে, বাড়ির বৌটি এগিয়ে দেন রাতপোশাক (নাইটি)। পোশাক বদলে নেন সকলে। এরপরে গ্রামের মেয়েরাই পথ দেখিয়ে সকলকে এগিয়ে দেন। পরে পুলিশের গাড়ি দেখতে পেয়ে ধড়ে প্রাণ ফেরে ছয় মহিলা কনস্টেবলের।
রুমা বিবি নামে গ্রামের এক মহিলা বলেন, ‘‘পুলিশ আমাদের মেরেছে-ধরেছে সে কথা ঠিক। কিন্তু গ্রামের মেয়েরা মিলে ঠিক করে, পুলিশের উর্দি পরা হলেও ওই মেয়েদের প্রাণে বাঁচাতেই হবে।’’
গ্রামের মহিলারা এই সৌজন্যটুকু না দেখালে মঙ্গলবার সুস্থ ভাবে ফেরা তাঁদের পক্ষে সহজ ছিল না, মানছেন মহিলা কনস্টেবলেরা। পাশাপাশি পুরুষ সহকর্মীদের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ তাঁরা। এক মহিলা কনস্টেবলের কথায়, ‘‘আমরা যে নিরস্ত্র অবস্থায় পিছনে পড়ে আছি, বিপদের সময়ে সে কথা কেউ ভাবলই না। দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সে কথা জানিয়েছি।’’