গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
উৎসবের আবহেও উঁকি দিচ্ছে শঙ্কার মেঘ। রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল (স্যাট)-এর রায়ে জয় এসেছে সরকারি কর্মীদের। কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্যাট। কিন্তু,রাজ্য সরকার স্যাটের এই নির্দেশ মেনে নেবে তো? নাকি আবার আইনি লড়াইয়ের পথে গিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় মহার্ঘ ভাতা আটকে দেবে সরকার? উল্লাস-উদ্যাপনের মধ্যেও এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিচ্ছে না কর্মী সংগঠনগুলি। বিরোধী দলের সংগঠনগুলি খোলাখুলিই বলছে এ বিষয়ে। আর শঙ্কার কথা মাথায় রেখেই শাসক দলের কর্মী সংগঠনের নেতারা বলছেন, স্যাটের রায়কে মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে।
শুক্রবারকেন্দ্রীয় হারে রাজ্য সরকারকেও কর্মীদের ডিএ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্যাট। চলতি বেতন কমিশনের কার্যকাল শুরুহওয়ার আগের ১০ বছরে অনিয়মিত ভাবে ডিএ দেওয়ার কারণে রাজ্য সরকারি কর্মীরা যে টাকা কম পেয়েছেন, বকেয়া হিসেবে ধরে সেই টাকা মিটিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে স্যাট। এই রায়ের পর থেকেই কার্যত উল্লাসে ফেটে পড়েছেন কর্মীরা। মামলাকারী কংগ্রেস সমর্থিত কর্মী সংগঠন কনফেডারেশন তো বটেই, অন্য সংগঠনগুলির মধ্যেও কার্যত খুশির হাওয়া। রায়কে স্বাগত জানিয়েছে সব কর্মী সংগঠনই।
কনফেডারেশনের তরফে সুবীর সাহা বলেন, ‘‘আমরা এই রায়ে অত্যন্ত খুশি। যে ক’টা দাবি স্যাটের কাছে পেশ করেছিলাম, সব দাবিই স্যাট মেনে নিয়েছে। এই রায়কে স্বাগত তো অবশ্যই জানাচ্ছি এবং মনে করছি কর্মীদের সঙ্গে সরকার যে বঞ্চনা বছরের পর বছর চালিয়ে আসছিল, তার বিরুদ্ধে তাঁরা আজ এক বিরাট জয় পেলেন।’’
বিজেপি সমর্থিত সংগঠন কর্মচারী পরিষদের রাজ্য কমিটির আহ্বায়ক দেবাশিস শীল বলেন, ‘‘স্যাট আজ ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। কর্মীদের আন্দোলনের ঐতিহাসিক জয় হয়েছে।’’
তৃণমূলের সংগঠন ফেডারেশন এবং সিপিএমের সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটিও স্বাগত জানিয়েছে রায়কে। তবে কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজয়শঙ্কর সিংহ তার সঙ্গে এ-ও বলেছেন যে, কর্মীদের অধিকার যতই স্বীকৃতি পেয়ে থাক স্যাটের রায়ে, একে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ফের আন্দোলনেই নামতে হবে।
আরও পডু়ন: কেন্দ্রীয় হারেই মহার্ঘ ভাতা দিতে হবে রাজ্যকে, জানিয়ে দিল স্যাট, বকেয়া মেটানোরও নির্দেশ
অতএব ‘ঐতিহাসিক’ এই জয়ের পরেও পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই সরকারি কর্মচারী মহল। অধিকাংশ সংগঠন এবং কর্মীদের আশঙ্কা, এত সহজে রাজ্য সরকার স্যাটের রায় মেনে নেবে না। হাইকোর্টে এবং স্যাটে শুনানি চলাকালীন যে দৃঢ়তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার দাবির বিরোধিতা করেছে রাজ্য সরকার, সে কথা কর্মীদের অজানা নয়। তার উপর শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী জানান, বেতন কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পরে বেতন সংস্কারও ‘সাধ্যমতো’ করবেন। তাই রাজ্যের কর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে। যে সরকার বেতন সংস্কারের বিষয়েই স্পষ্ট আশ্বাস দিতে রাজি নয়, কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়া এবং ১০ বছরের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ সেই সরকার একবাক্যে মেনে নেবে কি? প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে কর্মী মহলে। স্যাটের রায়ের ফলে যে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা রাজ্য সরকারের ঘাড়ে এসে পড়ল, তা বহন করতে সরকার আদৌ প্রস্তুত কি না, সে বিষয়েও সংশয় রয়েছে। ফলে কর্মী সংগঠনগুলির আশঙ্কা, রাজ্য সরকার ফের হাইকোর্টে যেতে পারে।
কিন্তু এই হাইকোর্টই তো বলেছিল, ‘ডিএ কর্মীদের অধিকার, সরকারের দয়ার দান নয়’। এই পর্যবেক্ষণ করে মামলাকে স্যাটে ফেরত পাঠিয়েছিল উচ্চ আদালত। সেই অনুযায়ীই রায় হয়েছে স্যাটে। এখন স্যাটের রায় চ্যালেঞ্জ করে মামলা করলে তাই হাইকোর্টের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে কর্মী সংগঠনগুলির নেতারা মনে করছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে রাজ্য সরকার। সেখানে ফের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে আরও দীর্ঘ সময় পিছিয়ে যেতে পারে কর্মীদের ডিএ পাওনা।
আরও পড়ুন: স্মৃতি ইরানি থেকে মিমি-নুসরত, আজম খানের মন্তব্যের নিন্দায় শাসক-বিরোধী
অধিকাংশ সংগঠনেরই মত, আর বিরোধিতা না করে এ বার সরকারের উচিত কর্মীদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া। না হলে সরকারকে আরও কর্মী-বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে। খোদ শাসক দলের সংগঠন ফেডারেশনও চাইছে, এই রায়কে যেন চ্যালেঞ্জ না করা হয়। ডিএ চাহিদা মতো না দেওয়া, বেতন কমিশন কার্যকর না করা— এ সবের ফলে সরকারি কর্মীদের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ এ বারের লোকসভা ভোটের পোস্টাল ব্যালটেই অনেকটা স্পষ্ট। এই রায়ে সেই কর্মীরাই উল্লসিত। রাজ্য সরকার যদি আর্থিক বোঝা এড়ানোর জন্য তা আটকানোর চেষ্টা করে, তা হলে ক্ষোভ আরও বাড়বে।
ফেডারেশনের মেন্টর গ্রুপের আহ্বায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘স্যাটের এই রায়কে স্বাগত না জানানোর কোনও কারণ নেই। আশা করছি, রায় অনুযায়ী রাজ্য সরকার ডিএ মিটিয়ে দেবে। সরকারের কাছে অনুরোধ করব, কর্মীদের এই দাবি এ বার মেনে নেওয়া হোক। সরকার যাতে এর বিরোধিতার পথে না হাঁটে, আমরা সেটাই চাইব।’’
কো-অর্ডিনেশনের নেতাদের ব্যাখ্যা, এরকম অনেক নির্দেশ আদালত দিয়েছে। কী ভাবে আইনের ফাঁকফোকর গলে, দীর্ঘ আইনি লড়াই চালিয়ে দাবিদাওয়া আচকে দেওয়া যায়, তা আগেও বিভিন্ন সরকারের ভুমিকায় দেখা গিয়েছে। বিজয়শঙ্করের কথায়, ‘‘আমাদের অধিকারটা স্বীকৃত হল। আমরা যা চাইছি, তা যে অন্যায্য নয়, সেটা স্যাটও বলে দিল। তার জন্য স্যাটকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা জানি যে, এই ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আমাদের আবার পথে নামতে হবে। কারণ স্যাট বা আদালত নির্দেশ দিতে পারে, কিন্তু সেটার রূপায়ণ ঘটিয়ে দিতে পারে না। পথে নেমে আন্দোলন না হওয়া পর্যন্ত এই সরকার কর্মীদের দাবি মেনে নেবে না, আমরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতও আছি।’’
সব পক্ষের একটাই প্রশ্ন, সরকার এখনই এই রায় মানবে কি? তবে এই আশঙ্কার দোলাচলের মধ্যেও বিজয়োল্লাসেই মেতেছে সব পক্ষ।