রাজ্য কি আদৌ শেষমেশ নাগরিকত্ব আইন নস্যাৎ করতে পারবে?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীমমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ রাজ্যে তিনি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন(সিএএ) কার্যকর হতে দেবেন না। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মনে করছেন, এটা রীতিমতো বেনজির ঘটনা।
রাজ্য যদি আইন না মানার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তাহলে কী হবে? সে ক্ষেত্রে কি কেন্দ্র রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারে এ রাজ্যে? সিএএ-কে ঘিরে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের এ রকম পরিস্থিতিতে কী হতে পারে তা নিয়ে চলছে জল্পনা। আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের মতামত জানাচ্ছেন।
রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল, আইনজীবী জয়ন্ত মিত্রকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান অনুযায়ী, নাগরিকত্ব কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়। সে বিষয়ে কেন্দ্র যদি কোনও আইন আনে তবে রাজ্যকে তা মানতেই হবে।”
ঠিক একই কথা বলেছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী দীপন সরকারও। তিনিও বলেন,‘‘সংবিধানের ২৫৬ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে দেওয়া রয়েছে, সংসদে প্রণীত আইন মেনে চলতে হবে রাজ্যকে। এমনকি রাজ্যকে সেই আইন মানার সরাসরি নির্দেশও দিতে পারেকেন্দ্র।”
আরও পড়ুন:হঠাৎ গৃহীত বৈশাখীর ইস্তফা, প্রতিহিংসা? ক্ষোভ উগরে প্রশ্ন শোভনে
একই মত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন,‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি ভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করছেন যে তিনি সিএএ মানবেন না। এটা ২৫৬ ধারার বিরুদ্ধে।”
তবে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সিএএ তাঁদের রাজ্যে চালু হতে না দেওয়ার যে কথা বলছেন, তা সাংবিধানিক ভাবে অবৈধ?
অমলবাবু মনে করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত সংবিধান বিরোধী। তিনি বলেন, ‘‘সংবিধানে খুব পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা রয়েছে, ২৫৬ ধারা অনুযায়ী যদি কেন্দ্রের নির্দেশ না মেনে নেয় রাজ্য এবং ওই কেন্দ্রীয় আইন লাগু না করে, ধরে নেওয়া হবে ওই রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা চলছে।’’ তিনি সিএএ বিরোধিতায় রাজ্যের এই অবস্থানকে বেনজির বলেও মন্তব্য করছেন। তাঁরকথায়, ‘‘সেক্ষেত্রে রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থার কারণে কেন্দ্র সংবিধানের ৩৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা করতে পারে। ”
আরও পড়ুন:জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধে উত্তপ্ত দিল্লি, ভাঙচুর স্কুলবাসে
জয়ন্তবাবু এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেন যে, একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রে আইন মানুষের জন্য। তাই কোনও আইন ঘিরে যদি মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ শুরু হয়, মানুষ যদি সেই আইনের বিরোধিতা করে, তবে কেন্দ্র সেই আইন মানুষের স্বার্থেই পুনর্বিবেচনা করতে পারে। রাজ্য সরকার মানুষের সেই প্রতিবাদের কারণ এবং ভোগান্তি হলেসেটাও কেন্দ্রের কাছে তুলে ধরতে পারে। পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাতে পারে। তিনি ব্রিটিশ ভারতের ১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের প্রসঙ্গ তোলেন। জয়ন্তবাবুর কথায়, ‘‘সেই সময় ওই আইন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। সেই প্রতিবাদ সরকারকে বাধ্য করেছিল ওই আইনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে। শেষ পর্যন্ত দেশজোড়া প্রতিবাদের মুখে ওই আইন রদ করতে বাধ্য হয় সরকার।” তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘রাজ্য যদি বলে কেন্দ্রীয় আইন মানব না, তা সাংবিধানিক এবং যুক্তরাজ্যের কাঠামোর বিরুদ্ধে। কিন্তু একই সঙ্গে রাজ্য প্রতিবাদীদের কণ্ঠস্বর কেন্দ্রের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।” তবে তিনি স্বীকার করেন,‘‘ভারতবর্য একটা বিশাল দেশ। এক এক জায়গার আলাদা আলাদা চরিত্র। সেখানে এক জন যদি বলে, আমি এই আইন মানব, অন্য কেউ বলবে ওই আইন মানব না, সেটা চলতে পারে না। তা দেশের অখন্ডতার বিরুদ্ধে।”
দীপনবাবুও একমত যে, কোনও কেন্দ্রীয় আইন নিয়ে রাজ্যের আপত্তি থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে সংবিধানে রাজ্যকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার। কলকাতা হাইকোর্টের অন্য এক আইনজীবী ব্যাখ্যা করেন,‘‘সংবিধানের ১৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, কোনও কেন্দ্রীয় আইন নিয়ে রাজ্যের আপত্তি থাকলে, রাজ্য শীর্ষ আদালতে ওই কেন্দ্রীয় আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।” ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রের তৈরি কর সংক্রান্ত একটি আইন এভাবেই চ্যালেঞ্জ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ যা পরবর্তীতে রদ করা হয়।
জয়ন্তবাবুও এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘‘শীর্ষ আদালতে ইতিমধ্যেই এই আইনের বিরোধিতা করে একাধিক জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে। এবার শীর্ষ আদালত সিদ্ধান্ত নেবে।” তবে শীর্ষ আদালত এখনই এই আইনের বিরোধিতায় দায়ের করা মামলা আদৌ গ্রহণ করতে পারে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আইন তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সিএএ-তে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই স্পষ্ট করে দেওয়া আছে, কেন্দ্র বিজ্ঞপ্তি জারি করার পরই সেই আইন কার্যকর হবে। যতক্ষণ না কেন্দ্র আইন কার্যকর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করছে ততক্ষণ সেই আইনে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেনকী করে? ফলে তার বিরোধিতার মামলা কতটা গ্রহণযোগ্য? সেক্ষেত্রে যারা মামলা করছেন, তাঁদের আদালতকে বোঝাতে হবে যে, ওই আইন চালু হলে তাঁরা কী রকম ভোগান্তির শিকার হবেন।’’ অমলবাবুও বলেন যে,‘‘রাজ্যের অধিকার রয়েছে আইনি পথে বিরোধিতা করার। কিন্ত সংবিধানের পরিধির বাইরে গিয়ে এ ভাবে বিরোধিতা করা যায় না।’’
জয়ন্তবাবু এবং দীপনবাবু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন আইনজীবী এবং কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য যদি আইন লাগু না করে, তবে সেই আইন লাগু না হওয়ার ফলে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাঁরা প্রথমে কলকাতা হাইকোর্ট এবং তার পর শীর্ষ আদালতে যেতে পারেন।” তাঁর ব্যাখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট, রাজ্য সিএএ না লাগু করলেএ রাজ্যের যাঁরা শরণার্থী হিসাবে নাগরিকত্ব পেতে পারতেন, তাঁরা বঞ্চনার প্রতিকার চেয়ে ব্যক্তি হিসাবে আদালতে যেতে পারেন।
এই পরিস্থিতিতে যে কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সংস্থানসংবিধানে যে রয়েছে,তা স্বীকার করছেন আইনজ্ঞরা। কিন্ত তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাস্তবে ভারতীয় সংবিধানের বিস্তৃতি এতটাই বেশি যে, অনেক বিষয় নিয়েই চূড়ান্ত কী হতে পারে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। অমলবাবু যেমন বলছেন,‘‘আইন না মানার সিদ্ধান্তে যদি রাজ্য সরকার অনড় থাকে তাহলে কেন্দ্র রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করলে তা সংবিধানবিরোধী হবে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জানেরাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হলে রাজনৈতিক ভাবে অ্যাডভান্টেজ পাবেন মমতা।” তাই সুযোগ থাকলেও কেন্দ্র সেই পথে যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন অমলবাবু।