সৌরভ স্মরণে। নিজস্ব চিত্র
একা সৌরভ চৌধুরী নন। দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে বামনগাছির ব্যানার্জিপাড়ায় একজোট হতে শুরু করেছিলেন এলাকার অনেক যুবকই। তৈরি হয়েছিল সামাজিক মঞ্চ ‘সত্যাগ্রহী’। এলাকার যুবকদের এই একজোট হওয়াকে ভাল ভাবে নেয়নি দুষ্কৃতীরা। সৌরভের মৃত্যুর পরে প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি প্রতিবাদীদের ভয় দেখাতেই সৌরভকে বেছে নেওয়া হয়েছিল? তাঁকে হত্যা করে আসলে এলাকার সব প্রতিবাদী যুবককেই কি ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল দুষ্কৃতীরা?
সত্যাগ্রহীর সদস্যদের কথায়, “ওরা কাউকে না কাউকে মারতই। সে-দিন সৌরভকে একা পেয়ে গিয়েছিল। সেই জন্যই ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে দিয়েছে।”
সৌরভের দাদা সন্দীপ এবং তাঁর বন্ধুরা জানাচ্ছেন, বছর পাঁচ-ছয় ধরে ব্যানার্জিপাড়ায় দুষ্কৃতীদের দাপট বাড়ছিল। তাঁদের কথায়, “এলাকায় রাত যত বাড়ে, ততই বাড়ে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। অন্ধকারে দুষ্কর্ম করতে রাস্তার আলো ভেঙে ফেলা হয়। চোলাই মদ, গাঁজা, হেরোইন রাতের ব্যানার্জিপাড়ায় এ-সব কিছুরই ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। পুলিশ সব জানে। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেয় না।” স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতে ব্যানার্জিপাড়ায় চলে বেআইনি মাদকের কারবার আর দিনের বেলা চলে বাসিন্দাদের জমি কম পয়সায় হাতিয়ে নিয়ে প্রোমোটারির ব্যবসা।
এর প্রতিবাদেই গত কালীপুজোর ঠিক আগে সৌরভের দাদা সন্দীপ, আকাশ, সৌরেন, রাজীব, শেখরেরা তৈরি করেন ‘সত্যাগ্রহী’ মঞ্চ। এখন ওই মঞ্চের সদস্য ২৫ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ‘সত্যাগ্রহী’র সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছিলেন সৌরভও।
কী উদ্দেশ্য সত্যাগ্রহীর? সৌরেন-শেখরেরা জানাচ্ছেন, এলাকার শিক্ষিত যুবকদের একজোট করে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়াই করাই এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। শেখর জানান, সংগঠন গড়ার লক্ষ্য ছিল সত্যের জন্য লড়াই চালানো। সেই জন্যই নাম দেওয়া হয়েছিল সত্যাগ্রহী। ওই সংগঠনে কোনও রাজনীতি ছিল না। এমনকী কোনও নেতাও ছিল না। সেই কারণে সত্যাগ্রহীতে কোনও সম্পাদক বা সভাপতি নেই। শেখরেরা বলছেন, “আমাদের সংগঠনে সবাই নেতা। প্রথম থেকেই শাসক দলের নেতারা এলাকার দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দিতেন। সেই জন্য আমরা এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকতে দিইনি। নিজেদের মতো করেই লড়াই চালাচ্ছিলাম।”
সৌরেনদের লড়াইয়ের কৌশলও অভিনব। দুষ্কৃতীদের রুখতে অস্ত্র তুলে না-নিয়ে তাঁরা উন্নয়নের রাস্তাই বেছে নিয়েছিলেন। অপরাধ ঠেকাতে নিয়মিত চাঁদা তুলে এলাকার রাস্তায় আলো লাগানোর ব্যবস্থা করতেন তাঁরা। এলাকায় সিন্ডিকেটের ব্যবসা, জমির বেআইনি কারবার রুখতেও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছিল সত্যাগ্রহী।
সৌরেনরা জানাচ্ছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তিন-চার বছর ধরেই জুটত দুষ্কৃতীদের হুমকি। কখনও কখনও আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে প্রাণে মারার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। সেই জন্যই একজোট হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন তাঁরা। শেখরদের কথায়, “তার পরে হুমকি বেড়ে গিয়েছিল। আমরা একসঙ্গে রাতে আড্ডা দিলেও অপরাধীদের দল এসে তাড়িয়ে দিত। ভয় দেখাত। সৌরভও আমাদের সঙ্গে থাকত। আমাদের শিক্ষা দিতেই ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”
সৌরভের মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলন করতে রবিবার বামনগাছি এলাকায় তৈরি হয়েছে নতুন মঞ্চ। ‘সত্যাগ্রহী’ ওই মঞ্চের সঙ্গে হাত মিলিয়েই লড়াই চালাবে কি না, সেই বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেননি শেখরেরা। তবে সৌরভের মৃত্যুতে ‘সত্যাগ্রহী’র সদস্যেরা পিছু হটতে নারাজ। সৌরভের দাদা সন্দীপকে সান্ত্বনা দিতে দিতে সৌরেনরা বলেন, “এলাকায় অপরাধ নির্মূল না-হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। একমাত্র আমাদের মেরে ফেললে তবেই লড়াই থামবে। প্রয়োজনে আমরণ অনশনে বসব। কিন্তু ভয় পেয়ে পিছু হটব না।”