Slogan in West Bengal Politics

বাংলাদেশের স্লোগানের রমরমা বঙ্গ রাজনীতিতে! পদ্মাপারের বড় প্রভাব গঙ্গাপারের আন্দোলনে

রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে তাঁরা সকলেই একমত যে, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের স্লোগানের পশ্চিমবঙ্গীয়করণই চলছে। নতুন স্লোগান তৈরি হচ্ছে না।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৪ ১০:২৮
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গত ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের স্লোগান ছিল ‘খেলা হবে’। পাশাপাশিই ছিল ‘জয় বাংলা’। দু’টি স্লোগানেরই জন্মভূমি বাংলাদেশ। সেই ভোটেই পাল্টা আখ্যান তৈরি করতে বিজেপি স্লোগান দিয়েছিল ‘সোনার বাংলা’র। সেই শব্দবন্ধের সঙ্গেও বাংলাদেশের নিবিড় যোগ রয়েছে।

Advertisement

আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে যখন উত্তাল বাংলা, তখন দেখা যাচ্ছে সিপিএম-বিজেপি স্লোগান দিচ্ছে ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।’ যে স্লোগান সামনে রেখে সম্প্রতি বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ থাকতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। কিন্তু এরই পাশাপাশি যে আলোচনা এ পার বাংলার রাজনীতিতে শুরু হয়েছে, তা হল —সাম্প্রতিক সময়ে কি বাংলাদেশের স্লোগানই মূলত দাপট দেখাচ্ছে এই বাংলার রাজনীতিতে? ও পারের স্লোগানে কি ‘ঝাঁজ’ বেশি? না কি নতুন স্লোগান তৈরিতে এ পার বাংলার রাজনৈতিক ঐতিহ্যে মরচে ধরেছে?

রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ব্যাখ্যাও রয়েছে। কিন্তু একটি বিষয়ে সকলেই একমত, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের স্লোগানের ‘পশ্চিমবঙ্গীকরণ’ চলছে। আর তা জনপ্রিয়ও হচ্ছে।

Advertisement

বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজনৈতিক স্লোগানের ইতিহাস দীর্ঘ। স্বাধীনতার আগে থেকে তা চলে আসছে। বাংলা তথা বাঙালির দেওয়া স্লোগান জাতীয় স্তরের স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছিল। সে সব স্লোগান কালোত্তীর্ণ হয়ে থেকেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাতেও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে বছরের পর বছর।

তেভাগা আন্দোলনের সময়ে ‘লাঙল যার, জমি তার’ স্লোগান কৃষক আন্দোলনে কার্যত অগ্নিবর্ষণ করেছিল। ষাট বা সত্তরের দশকে বামেদের রাজনীতি ছিল মূলত জমিকেন্দ্রিক। সেই সময়েও ওই স্লোগান ফিরে এসেছিল। জোতদার জমিদারদের হাত থেকে ‘বেনামি জমি’ দখল করে তা ভাগচা‌ষিদের মধ্যে বিলিবণ্টন করার কর্মসূচিতে তেভাগার স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছিল। নকশালবাড়ি আন্দোলনে আবার চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন স্লোগানের বঙ্গীকরণ করা হয়েছিল। ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ বা চিনা বিপ্লবের লাইন ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ স্লোগান হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। দেওয়ালে দেওয়ালে এ-ও লেখা হয়েছিল, ‘চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’।

এ পার বাংলায় বাম জমানার দীর্ঘ সময়ের একটা বড় অংশে নতুন স্লোগান সে ভাবে তৈরি হতে দেখা যায়নি। তবে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পরে প্রথম লোকসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ স্লোগান ঘুরেছিল মানুষের মুখে মুখে। তার পরবর্তী কালে এসেছিল ‘কেশপুর সিপিএমের শেষপুর’।

তার পরে আবার ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্টের স্লোগান ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ রাজ্য রাজনীতিতে আলোচ্য হয়ে উঠেছিল। যদিও অনেকের মতে, সেই স্লোগান আন্দোলনের ছিল না। তার চেয়ে বেশি ছিল সরকারের উন্নয়নের অভিমুখের। সে দিক থেকে মৌলিক একটা ফারাক ছিল। ২০০৯ সাল থেকে ‘পরিবর্তন চাই’ স্লোগান আলোড়িত করেছিল বাংলার রাজনীতিকে। জুড়ে গিয়েছিল ‘মা-মাটি-মানুষ’ও। সেই পর্বের পরে পশ্চিমবঙ্গে সে অর্থে ‘রাজনৈতিক স্লোগান’ তৈরি হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেক মহলেই। আরজি কর-কাণ্ডে অরাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্লোগান উঠছে, ‘তোমার স্বর, আমার স্বর, আরজি কর আরজি কর’। এই স্লোগানের মধ্যেও ‘তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’-এর ছায়া রয়েছে। যা পুরনো স্লোগানের নবীকরণ বললে অত্যুক্তি হবে না।

রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য তথা ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের বক্তব্য, ‘‘বাংলাদেশের স্লোগান এ পারে ব্যবহৃত হওয়াটা অন্যায় বলে মনে করি না। এটাকে ভাষাগত ঋণ বলা যেতে পারে। যা কিছু শুভ, তা আমরা গ্রহণ করতেই পারি।’’ আবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান প্রশান্ত রায়ের বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে হয়তো নতুন স্লোগান তৈরির প্রয়োজনীয়তাই পড়ছে না। সে কারণেই নতুন স্লোগান তৈরি হচ্ছে না। তবে আরজি কর-কাণ্ডে যে নাগরিক আন্দোলন দেখছি, তাতে খুব যে রাজনৈতিক স্লোগানের দাপট রয়েছে, তেমন মনে হচ্ছে না।’’

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে ‘খেলা হবে’ স্লোগান প্রথম শোনা গিয়েছিল বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের নেতা শামিম ওসমানের মুখে। কিন্তু তার এতটাই ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে যে, পবিত্র জানতেন সেটি অনুব্রত মণ্ডলের তৈরি করা স্লোগান। আবার প্রেসিডেন্সির প্রশান্ত এত দিন জানতেন, মমতাই ওই স্লোগানের স্রষ্টা।

প্রবীণ তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায়ের বক্তব্য, স্লোগান তৈরিতে যে মেধা লাগে, তার সামগ্রিক অবনমন ঘটেছে। সে কারণেই স্লোগান ‘ধার’ নিতে হচ্ছে। নির্বেদের কথায়, ‘‘যে মধ্যবিত্ত অংশ স্লোগান তৈরি করত, নানা কারণে তার একটা অবনমন ঘটেছে। কৃষক বা শ্রমিকের জন্য স্লোগান কখনও সেই অংশ থেকে তৈরি হত না। তৈরি হত মধ্যবিত্ত অংশ থেকেই। সেই জায়গায় একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে।’’ তিনি এ-ও মনে করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব থাকার সময়ে দেশের নানা রাজনৈতিক বাঁকে স্লোগান তৈরি হয়েছে। সেই পরিস্থিতি বদল মৌলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল ঘটিয়েছে বলেও অভিমত তাঁর। রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, ‘‘সার্বিক ভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান নেমে গিয়েছে বলেই এই অবস্থা।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা যখন ছাত্র আন্দোলন করছি, তখন কমিউনিস্টদের পাল্টা আক্রমণ করার জন্য আমরা সোভিয়েতের কমিউনিস্টদের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে চর্চা করতাম। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রৈকাও রাজনৈতিক অনুশীলনকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। সে সব এখন নেই।’’ বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখপাত্রের উদাহরণ, ‘‘সত্তরের দশকের গোড়ায় সিপিআই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধায় সিপিএম স্লোগান দিয়েছিল, ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ সেই ভোটে সিপিএম শোচনীয় ফল করেছিল। সিপিআইয়ের ফল হয়েছিল ভাল। পাল্টা সিপিএমকে কটাক্ষ করে সিপিআই দেওয়ালে লিখেছিল, ‘সেই বাছুরের খেয়ে লাথ, সিপিএম কুপোকাত।’ এই বুদ্ধিদীপ্ততাটাই রাজনীতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে।’’

সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বাংলাদেশের স্লোগানকে এই বাংলায় ব্যবহার করার মধ্যে দোষ দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য, এ পার বাংলাতেও নতুন স্লোগান তৈরি হচ্ছে। আবার ও পারের স্লোগানকেও নেওয়া হচ্ছে। সেলিমের কথায়, ‘‘বাঙালি জাতিগত ভাবে অখণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দু’পারেই সমান ভাবে রয়েছে। ফলে স্লোগান কাঁটাতার পেরিয়ে এলেও তার মধ্যে দোষের কিছু নেই।’’ তাঁর এ-ও ব্যাখ্যা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনে বিভিন্ন স্লোগানের বঙ্গীকরণ হয়েছে। সিএএ-এনআরসির সময়ে ‘কাগজ দেখাব না’ উত্তর ভারতে তৈরি হওয়া স্লোগান। তা এখানেও আছড়ে পড়েছিল। সেলিম-শমীক একটি বিষয়ে একমত। এই যে পদ্মাপারের স্লোগান বেশি বেশি করে গঙ্গাপারে অনুরণিত হচ্ছে, তার সবচেয়ে বড় কারণ সমাজমাধ্যম। পৃথিবী ছোট হয়ে গিয়েছে। গান থেকে স্লোগান— সবই এখন এজমালি সম্পত্তি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement