হাসপাতালের বাইরে প্লাস্টিক বিছিয়ে রোগিণী। ছবি: সুমন বল্লভ
গাছতলায় প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়েছিলেন দম্পতি। স্ত্রীর মুখের একটা অংশ বেগুনি কালিতে দাগানো। দেখে বোঝা যায়, রেডিয়োথেরাপি চলছে। মাথার কাছে বছর ছয়েকের একটি ছেলে বাতিল কাগজ নিয়ে খেলে চলেছে। মহিলার স্বামী ঠোঙা থেকে মুড়ি নিয়ে কখনও নিজে খাচ্ছেন। কখনও ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন। গত তিন সপ্তাহ সরকারি হাসপাতাল চত্বরই ঘরবাড়ি বাঁকুড়া থেকে আসা পরিবারটির। নেতিয়ে পড়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ় স্বামী হতাশ গলায় বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, আরও তিন সপ্তাহ ‘রে’ দেওয়া হবে। কিন্তু এ ভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। রাতের পর রাত রাস্তায় পড়ে থেকে ছেলেটাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কপালে যা আছে হবে। বাড়ি ফিরে যাব।’’
কপাল? যে রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে বেড থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার, ওষুধ, পরীক্ষানিরীক্ষা ফ্রি, ক্যানসারে কেমোথেরাপির দামি ওষুধও সরকারের তরফে বিনামূল্যে দেওয়া হয়, সেখানে চিকিৎসা শেষ করার জন্য রোগীর পরিবারকে ‘কপাল’-এর ভরসা করতে হবে কেন? সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত, তাঁরা বলছেন, অর্থের অভাব নেই। সদিচ্ছাও রয়েছে। কিন্তু নেই সঠিক পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতা। তাই ক্যানসারের মতো অসুখের ক্ষেত্রে চিকিৎসা না-করিয়ে অন্তিম দিন গোনা কিংবা মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
এখনও পর্যন্ত ক্যানসারের উন্নত চিকিৎসা, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সবটাই শহরকেন্দ্রিক। প্রতি বছর এ রাজ্যে প্রায় ৭০ হাজার নতুন ক্যানসার রোগীর যে হদিস পাওয়া যায়, তাঁদের বড় অংশই জেলার বাসিন্দা। এখনও পর্যন্ত সব জেলায় ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। শহর থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গিয়ে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ হয়েছে। তিনটি জেলায় রেডিয়োথেরাপির যন্ত্র বসেছে। কয়েকটি জেলায় ক্যানসার বিভাগ রয়েছে। কিন্তু রেডিয়োথেরাপির যন্ত্র বসেনি। কেমোথেরাপি হয়, কিন্তু কেমোর বহু ওষুধই সেখানে অমিল। তাই শহরে না-ছুটে উপায় থাকে না মানুষের। চিকিৎসার পরিকল্পনা, কেমোথেরাপির ডোজ় স্থির করা, অস্ত্রোপচার, লিনিয়র অ্যাক্সিলারেটর যন্ত্রে উন্নত রে়ডিয়োথেরাপির সুযোগ পাওয়া এখনও কলকাতা-নির্ভর। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। শহরে এসে এক দিন ডাক্তার দেখিয়ে পরের দিন ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। কমপক্ষে টানা দেড়-দু’মাস ঘরবাড়ি ছেড়ে, রুজিরোজগার বন্ধ রেখে শহরে পড়ে থাকার অর্থ পেটে টান পড়া। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে পড়ে থাকা এক তরুণের কথায়, ‘‘সরকারি হাসপাতালে সব ফ্রি পেয়েও তো সর্বস্বান্ত হতে বসেছি। দিনমজুরের কাজ করি। বাবার ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য এখানে পড়ে আছি। কাজ নেই, রোজগারও নেই। চিকিৎসার খরচ না লাগলেও খাওয়ার খরচ তো জোগাড় করতে হচ্ছে। প্রথম ক’দিন শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে সস্তার হোটেলে ছিলাম। খরচ টানতে পারলাম না। এখন হাসপাতাল চত্বরেই পড়ে থাকি। কত দিন পারব জানি না।’’
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন সরকারি পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা, হয়তো উত্তরবঙ্গ থেকে কোনও রোগী কলকাতায় এলেন। এক্স রে, আলট্রাসাউন্ড করাতে বললেন ডাক্তার। রোগী খুব তাড়াতাড়ি হলেও ‘ডেট’ পেলেন হয়তো সাত দিন পরে। এই সাত দিন তিনি থাকবেন কোথায়? হয় তাঁকে ফিরে যেতে হবে। নয় থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তিনি পরীক্ষা নিজের খরচে বাইরে করিয়ে নেন, তা হলে তাঁর কেমো বা রেডিয়েশন শুরু হল। হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তা খুবই সঙ্কটাপন্ন রোগীদের জন্য। রেডিয়োথেরাপির রোগীকে রে়ডিয়েশন নিয়ে ফিরে যেতে হয়। প্রশ্ন হল, ফিরে তিনি যাবেন কোথায়? শহরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা নেই। জেলায় ফিরে গেলে তাঁকে গাড়িভাড়া জোগাড় করে ফের আসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তিনি খেতমজুর বা দিনমজুর হন, তা হলে থেকে যাওয়া মানে এক-একটা কাজের দিন নষ্ট হওয়া। অথচ শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ তাঁকে জোগাড় করে নিতে হচ্ছে। সুবীরবাবুর কথায়, ‘‘সরকারি পরিষেবা ফ্রি হলেও তা পাওয়ার জন্য মানুষকে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আর সেই খরচ চালাতে না পেরে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেকেই।’’
ক্যানসার চিকিৎসক অনুপ মজুমদার বলেন, ‘‘সব ওষুধ ফ্রি ঠিকই। কিন্তু ঠিক সময়ে দাম মেটানো হয় না বলে দামি ওষুধের অনেক সময়ে সাপ্লাই থাকে না। তখন রোগীকে হয় চিকিৎসা থামিয়ে দিতে হয়। কিংবা নিজে কিনে নিতে হয়।’’ কঠিন অসুখে জেলার হাসপাতালের উপরে মানুষের ভরসা এখনও কম। ডাক্তারদের বড় অংশ এখনও ক্যানসারের অস্ত্রোপচারের জন্য শহরে রেফার করতে স্বচ্ছন্দ। তার বড় কারণ, অস্ত্রোপচার যথাযথ ভাবে হয়ে গেলেও পরবর্তী দেখভালের পরিকাঠামো এখনও দুর্বল। জেলার তিন-চারটি মেডিক্যাল কলেজ বাদ দিলে আর কোথাও রেডিয়োথেরাপির ব্যবস্থা নেই। এসএসকেএমের এক ক্যানসার চিকিৎসকের কথায়, ‘‘কোনও রোগীকে হয়তো আমরা লিখে দিলাম, তিন সপ্তাহ পরে ভর্তি হতে হবে। তিন সপ্তাহ পরে তিনি এসে শুনলেন, বেড নেই। সেই যে তিনি চলে গেলেন, তার পরে অনেক সময়েই আর ফেরেন না। কী ভাবে ফিরবেন? যাতায়াত, শহরে থাকা-খাওয়ার সামর্থ্য আছে নাকি?’’ আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের এক ক্যানসার চিকিৎসকের কথায়, ‘‘কেমোর খুব দামি ইঞ্জেকশন মাসে একটা করে নেওয়ার কথা রোগীর। ফ্রি-তে সেই ওষুধ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু তিন-চার মাস পরে জেলার একাধিক রোগী তা নিতেই আসেন না। কারণ,এলে তো অন্য দিকের খরচ জোগাড় করতে হবে।’’
‘অন্য দিকের খরচ’!
এই গেরোতেই আটকে যাচ্ছেন জেলার ক্যানসার রোগীরা।