(বাঁ দিকে) বালুরঘাট হাসপাতালে বিক্ষোভ। (ডান দিকে) সদ্যোজাতের বাবা বাবলা মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামোর হাল যে প্রায় একই রয়েছে তা ফের স্পষ্ট করে দিল বালুরঘাটের সরকারি হাসপাতালে আঙুল খোয়ানো শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। আগেও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের এক যুবকের পায়ে প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন থাকলেও এখানে তাঁর চিকিৎসা করানো যায়নি। তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কেন আজও প্লাস্টিক সার্জারির পরিকাঠামো গড়ে তোলা গেল না তা নিয়ে দায় নানা যুক্তি দিচ্ছেন বামেরা। পিছিয়ে নেই তৃণমূল আমলের মন্ত্রীও। চলছে চাপানউতোরও।
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা বর্তমানে শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের সময়তেও সুপার স্পেশালিটি বিভাগ চালুর কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। গত চার বছরেও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে সে ধরনের কোনও পরিষেবা গড়ে ওঠেনি। চিকিৎসকদের একাংশও মনে করেন উত্তরবঙ্গের মতো এলাকা বিচার করে এখানকার অন্যতম উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুপার স্পেশালিটি শল্য বিভাগ, পেডিয়াট্রিক সার্জারির পরিকাঠামো অবিলম্বে গড়ে তোলা দরকার। অশোকবাবু বলেন, ‘‘আমার সময় সুপার স্পেশালিটি ব্যবস্থা করা হয়নি ঠিকই তবে ট্রমা সেন্টার, ডায়ালিসিস ব্যবস্থা, নিউরো, নেফ্রো এবং কার্ডিওলজির আলাদা ভবন তৈরি করা হয়েছিল। হাসপাতালের ভবন তৈরির কাজে ১৬ কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছ থেকে চেয়ে আনা হয়েছিল। অথচ ট্রমা সেন্টার এখনও চালু হল না।’’ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘৩৪ বছরের বাম জমানায় কোনও কিছুই হয়নি। গত চার বছরে অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার সুপার স্পেশালিটি কার্ডিও থোরাসিক ইউনিট তৈরিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া সুপার স্পেশালিটি ইউনিট তৈরির প্রক্রিয়াও চলছে।’’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালতে সুপার স্পেশালিটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সুপার স্পেশালিটি সার্জিক্যাল ইউনিট ছাড়াও সেখানে কার্ডিও থোরাসিক বিভাগ, ক্যাথল্যাব। নেফ্রলজির অধীনে উন্নত ডায়ালিসিস ইউনিট গড়ে তোলার কথা। করা হবে উন্নত রেডিও থেরাপি ইউনিটও। তবে ওই প্রকল্পের জন্য ডিটেল প্রজেক্ট রিপোর্ট (ডিপিআর) পাঠানো হয়েছে।
পক্ষান্তরে, মেডিক্যালে ওই বব্যস্থা যে নেই তা নানা সূত্রে জানলেও কেন বালুরঘাট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘রেফার’ করে শিশুটিকে হয়রান করলেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রবিবার রাত দুটো নাগাদ বালুরঘাট হাসপাতাল থেকে সদ্যোজাত ওই শিশুকে নিয়ে তার বাবা বাবলা মণ্ডল ও মা মামনিদেবী সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সে শিলিগুড়ির উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রওনা হন। সকাল ৯টা নাগাদ তারা শিলিগুড়িতে পৌঁছন। সেখানে আঙ্গুল জোড়ার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বলে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়। সামান্য কৃষিজীবী বাবলা মণ্ডল বিপাকে পড়েন। উপায় না দেখে হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বাদে ফের তাঁরা বালুরঘাটের দিকে রওনা হন। প্রচণ্ড গরম, রাস্তায় যানজটের ধকল সয়ে এ দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ তারা যখন বালুরঘাট হাসপাতালে পৌঁছলেন, তখন তাঁরা ঠিকমত কথাও বলতে পারছিলেন না।
একটানা প্রায় ১৩-১৪ ঘণ্টা যাতায়াতের ধকল ও হয়রানি সদ্যোজাত ও তার বাবা মাকে কেন সহ্য করতে হল, তার সদুত্তর জেলা স্বাস্থ্যকর্তা থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউই দিতে পারেননি। পুরো ঘটনার কথা শুনে বালুরঘাট জেলা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা পূর্তমন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কেন এমন হলো তা জানতে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলব।’’
রবিবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ শিশুটির আঙুল কাটা পড়ে। চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, আট-নয় ঘণ্টার মধ্যে কাটা অংশ প্লাস্টিক সার্জারিতে জোড়া লাগার সম্ভাবনার কথা থাকলেও বালুরঘাট থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছতে অন্তত সাত ঘণ্টা সময় লাগে। সেই সুযোগ থাকলেও শিশুটিকে নিয়ে ভোর ছ’টার মধ্যে পৌঁছতে হত। বালুরঘাট থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দূরত্বে থাকা নিকটবর্তী মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেখানে ওই চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। শিলিগুড়িতে বেসরকারি নার্সিংহোমে ওই চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও তা চিকিৎসকেরা জানেন না। তা হলে হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা ওই তথ্য না জেনে শিশুটিকে শিলিগুড়িতে রেফার কেন করলেন? সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার পর কি তড়িঘড়ি পরিবারটিকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল?
বালুরঘাট হাসপাতালের সুপার তপন বিশ্বাসের ব্যাখ্যা, ‘‘আমি হাসপাতালের প্রশাসন দেখি। চিকিৎসকেরা রেফার করেন।’’ হাসপাতালের ওই রোগীকে যিনি রেফার করেন সেই চিকিৎসক নির্মাল্য দাসের কথায়, ‘‘রেফারের নিয়মেই রোগীকে কোনও সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছিল।’’ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুকুমার দে বলেন, ‘‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। সবদিক খতিয়ে দেখা হবে।’’
সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্তারা যাই বলুন না কেন, শিশুর বাবা বাবলা মণ্ডলের প্রশ্ন, ‘‘এত কিছুর পর ফের যদি বালুরঘাট হাসপাতালেই ভর্তি হতে হয়, তবে আগেই সেটা কেন করা হলো না?’’ হাসপাতাল সুপার থেকে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অবশ্য ওই শিশুকে পুনরায় বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সব রকম চিকিৎসা ও খরচের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু বাসিন্দাদের প্রশ্ন থেকেই গেল, ‘‘উত্তরবঙ্গের কোনও সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ কেন তৈরি হবে না?’’