ক্র্যাচে ভর করে এলেন ইন্দ্রনীল, স্বাগত জানাতে তৈরি গোটা স্কুল

স্কুল শুরুর আগে পড়ুয়ারা দাঁড়িয়েছিল প্রার্থনার লাইনে। সামনে অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তাঁদের মধ্যেই ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়েছিলেন সদ্য স্কুলে যোগ দেওয়া এক যুবক। তাঁকে দেখিয়ে স্কুলের শিক্ষক নির্মাল্য মিত্র বললেন, ‘‘এই শিক্ষককে দেখুন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আজ জীবনে সাফল্য পেয়েছেন।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২৪
Share:

ক্লাস নিতে ঢুকছেন নতুন মাস্টারমশাই। ছবি:নির্মাল্য প্রামাণিক।

স্কুল শুরুর আগে পড়ুয়ারা দাঁড়িয়েছিল প্রার্থনার লাইনে। সামনে অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তাঁদের মধ্যেই ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়েছিলেন সদ্য স্কুলে যোগ দেওয়া এক যুবক। তাঁকে দেখিয়ে স্কুলের শিক্ষক নির্মাল্য মিত্র বললেন, ‘‘এই শিক্ষককে দেখুন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আজ জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। ইচ্ছা আর মনের জোর থাকলে সাফল্য পেতে হলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।’’

Advertisement

যাঁকে নিয়ে এত কথা, সেই ইন্দ্রনীল সরকার বৃহস্পতিবারই যোগ দিয়েছেন বনগাঁ শহরের কলেজপাড়ার বিভূতিভূষণ প্রাইমারি স্কুলে। বছর চব্বিশের ওই যুবকের বাড়ি শহরের বিচুলিহাটা এলাকায়।

দিন কয়েক আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘির রায়মণিখাকি স্কুলে হুইলচেয়ারে এসে চাকরি যোগ দিতে গেলে অর্ণব হালদার নামে এক শিক্ষককে বাধা দেন কিছু গ্রামবাসী-অভিভাবক। তিনি ছেলেমেয়েদের ঠিক মতো পড়াতে পারবেন না বলে আগাম আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিক্ষোভকারীরা। শেষমেশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অবশ্য কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি। তবে ইন্দ্রনীলবাবুর ক্ষেত্রে এমন কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

Advertisement

ইন্দ্রনীলবাবু স্কুলে যোগ দিতে এলে শিক্ষক-শিক্ষিকা, পড়ুয়া, অভিভাবকেরা তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রধান শিক্ষিকা শর্মিলা রাহা বলেন, ‘‘প্রথম দিনই আমরা প্রার্থনা সঙ্গীতের সময়ে ইন্দ্রনীলবাবুকে সামনে রেখে পড়ুয়া, অভিভাবকদের সামনে একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরেছি। ওঁর লড়াইয়ের কথা সকলকে বলেছি।’’

এই পরিবেশ পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি ইন্দ্রনীলবাবু। তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম, শিক্ষকতা করব। স্বপ্নপূরণ হওয়ায় আমি খুশি। তা ছাড়া, এমন পরিবেশে পড়াব জেনে খুবই ভাল লাগছে।’’

ইন্দ্রনীলবাবু বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর জীবনের লড়াইটাও কম নয়। জন্মের কিছু দিন পরেই সেরিব্রালপালসি রোগে আক্রান্ত হন। দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন না। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতেও দমে না গিয়ে অদ্যম মানসিক জোরে এগিয়ে গিয়েছেন স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ে।

দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। নিজের সাফল্যের পিছনে মা অঞ্জনাদেবীর ভূমিকা সব থেকে বেশি বলে জানালেন। বাবা প্রশান্তবাবু নিজেও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। ছেলের সাফল্যে তিনিও খুশি। বললেন, ‘‘ছেলে আমরা কখনও বুঝতে দিইনি, আর পাঁচটা ছেলের থেকে ও কোনও অংশে কম। সে কারণেই ওকে সাধারণ স্কুলে লেখাপড়া করিয়েছি। কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, এমন কিছু থেকে ওকে সব সময় দূরে রেখেছি।’’ যে পরিবেশে ছেলে যোগ দিল চাকরিতে, তা জেনে আপ্লুত প্রশান্তবাবুও।

নতুন শিক্ষক সম্পর্কে কী বলছেন অভিভাবকেরা?

কৃষ্ণেন্দু ঘোষ, কার্তিক বাছারের কথায়, ‘‘শুধুমাত্র মনের জোরেই বিশ্ব জয় করা যায়। ইন্দ্রনীলবাবু আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত।’’ স্কুলের সহকর্মী সোমা চট্টোপাধ্যায়, অসীম দত্তরা বলেন, ‘‘নতুন মাস্টারমশাইকে দেখিয়ে আমরা অভিভাবকদের বলছি, বাড়িতে শারীরিক প্রতিবন্ধী কেউ থাকলে তাদের নিরুৎসাহ করবেন না। ওদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করুন।’’

ইন্দ্রনীলবাবুর পরিচিত একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুব্রত বক্সী সোমবার ওই স্কুলে গিয়েছিলেন, ইন্দ্রনীল কেমন পড়াচ্ছেন দেখতে। বললেন, রায়দিঘির ঘটনাটা যে নেহাতই বিচ্ছিন্ন, তা বোঝা যায়। ইন্দ্রনীল স্কুলে যে পরিবেশ পেয়েছে, সে জন্য স্কুলের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। এটা আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement