এক পক্ষের চাই সাত। অন্য পক্ষের স্রেফ একটি।
শিলিগুড়ি সরগরম এই সাত বনাম একের লড়াই নিয়ে! আর এই লড়াই যেন হঠাৎ করে শিলিগুড়িকে মিলিয়ে দিয়েছে গো-বলয়ের সেই বহুল চেনা ‘ঘোড়া কেনাবেচার’ রাজনীতির সঙ্গে। ‘নীতি-আদর্শ শিকেয় তুলে’ কী ভাবে এক দল আর এক দলের জয়ী প্রার্থীদের কব্জা করতে মরিয়া, পুরভোটের ফল বেরোনোর পরে তা নিয়েই শহরে আলোচনা তুঙ্গে। এর আগে রাজ্যসভায় সাংসদ পাঠানোকে ঘিরে বিধায়ক ‘কেনাবেচার’ অভিযোগ উঠেছে এ রাজ্যে। উত্তরের এই শহরেও সেই ইঙ্গিত।
কেন এই অবস্থা? কারণ, ৪৭ আসনের শিলিগুড়ি পুরসভায় বোর্ড গড়তে ২৪টি আসন দরকার। বামেরা পেয়েছে ২৩টি। তৃণমূলের ঝুলিতে ১৭। কংগ্রেস ৪টি, বিজেপি ২টি এবং তৃণমূল ছেড়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়ানো এক নেতার দখলে একটি ওয়ার্ড। অর্থাৎ, পুরবোর্ড গড়তে বামেদের চাই আর একটি আসন। তৃণমূলের দরকার আরও সাত কাউন্সিলরকে সঙ্গে পাওয়া। অঙ্কের হিসেবে যা মিলে যাচ্ছে কংগ্রেস, বিজেপি ও নির্দল মিলে। দড়ি টানাটানি অতএব এই সাত ও এক নিয়েই! এই বাজারে তাই নির্দলকে কাছে টানতে আসরে নেমে পড়েছে দুই শিবিরই। তৃণমূলের অন্দরের খবর, দলের একাধিক নেতা কংগ্রেস-বিজেপি-নির্দলকে টেনে বোর্ড গড়তে দিনভর ছক কষে চলেছেন। শুধু তাই নয়, এক তৃণমূল নেতা তো প্রাথমিক হিসেবের পরে দেনা-পাওনা নিয়ে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে কলকাতায় চলে গিয়েছেন বলে দল সূত্রেই জানা যাচ্ছে!
এই খবর চাপাও থাকছে না। কংগ্রেস-বিজেপি-নির্দল, তিন পক্ষই মানছে, বাম ও তৃণমূল শিবির থেকে তারা ডাক পাচ্ছে। কোনও কাউন্সিলর মেয়র, ডেপুটি মেয়র হওয়ার ‘অফার’ মিলেছে বলেও দাবি করছেন। কোথাও আবার মোটা টাকা দেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। নরম কথার সঙ্গে গরম হাওয়াও বইছে শহরের আনাচেকানাচে। এক জয়ী প্রার্থীর অনুগামীদের একাংশের অভিযোগ, তাঁদের ব্যবসা ক্ষেত্রে বিক্রয় কর সংক্রান্ত হানা হলে কী ভাবে সামলানো যাবে, সেই প্রশ্ন তুলে ভয় দেখানো হয়েছে। কোথাও আবার জয়ী প্রার্থীর কর্মরত আত্মীয়-স্বজনদের বদলি করে দেওয়া কিংবা ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যায় পড়লে কে বাঁচাবে, তা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ ইতিউতি শোনা যাচ্ছে। গো-বলয়ের রাজনীতি তো এমনই! ক্ষমতায় আসতে পদ কিংবা টাকার প্রস্তাব, না মানলেই হুমকি।
বিরোধীদের কটাক্ষ, ‘‘এই জমানায় সবই সম্ভব! ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী বিধায়কদের ভাঙিয়ে রাজ্যসভায় সাংসদ পাঠাতে কতটা মরিয়া হয়ে উঠতে পারে শাসকদল, তা ইতিমধ্যেই দেখেছেন এ রাজ্যের মানুষ। একের পর এক বিরোধীদের দখলে থাকা পুরসভায় কাউন্সিলরদের টোপ দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে পুরবোর্ড দখল করার নজিরও কম নয়। ফলে, শিলিগুড়ির মতো শহরেও যে এটা হবে, তাতে আর বিস্ময়ের কী!’’
তাঁর শহরে যে সেই চেষ্টা চলছে, তা মানছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অশোক ভট্টাচার্যও। তাঁর দাবি, তাঁরা রাজনীতিতে এ ধরনের ঘোড়া কেনাবেচার ঘোর বিরোধী। তৃণমূলের নাম নিচ্ছেন না। কিন্তু অশোকবাবু বলে দিচ্ছেন, ‘‘শিলিগুড়ি পুরবোর্ড কাদের হাতে তুলে দিতে শহরের মানুষ রাজি নন, সেটা তাঁরা ভোটের রায়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার পরেও যে দল ঘোড়া কেনাবেচার চেষ্টা করছে, তারা যেন শহরের সেই মেজাজটা মাথায় রাখে।’’
তা হলে বামেরা কেন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী নির্দল প্রার্থী অরবিন্দ ঘোষ ওরফে অমুকে সমর্থনের জন্য নানা ভাবে অনুরোধ করছে? কেনই বা বামেদের তরফে এক জন কংগ্রেস-বিজেপির কাউন্সিলরদেরও ফোন করে চলেছেন বলে শোনা যাচ্ছে? অশোকবাবুর যুক্তি, ‘‘তৃণমূল থেকে বেরিয়ে এসে অমুবাবু নির্দল হিসেবে জিতেছেন। ওঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। আমরা ওঁর কাছে চিঠি পাঠিয়ে সমর্থন চেয়েছি। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলকে হারিয়ে যাঁরা জিতেছেন, সকলকেই আমরা প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দেব।’’
অমুবাবু নিজেই বলছেন, ‘‘বাম বিরোধী তিন দল তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি মিলে বোর্ড গড়ার প্রস্তাব পেয়েছি। মেয়র, ডেপুটি মেয়র হওয়ার প্রস্তাবও মিলেছে। কিন্তু, যে দল ছেড়ে এসেছি সেই তৃণমূলে ফেরা বা তাদের সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয়। স্বচ্ছ এবং স্থায়ী বোর্ড গড়তে বামেরা এগিয়ে আছে, তা স্বীকার করতেই হবে।’’ তিনি জানান, বামেদের চিঠি পেয়েছেন। তবে, তাদের কিছু শর্ত দেবেন। সেটা মানা হবে বলে লিখিত ভাবে জানালে পরের পদক্ষেপ। কংগ্রেসের কাউন্সিলর সুজয় ঘটক বলেন, ‘‘অনেকেই ফোন করেছেন। দলের নীতি মেনেই এগোব।’’ বিজেপির জেলা সভাপতি রথীন বসুর দাবি, তৃণমূল কিংবা বামেদের তরফে নানা চেষ্টা করা হলেও তাঁরা সমদূরত্ব বজায় রাখবেন।
তৃণমূলের তরফে বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না। উত্তবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এবং তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেব বলেন, ‘‘কার সঙ্গে কী ভাবে সমঝোতা হতে পারে, তা নিয়ে দলের নীতি রয়েছে। সেটা প্রদেশ নেতৃত্ব ঠিক করে থাকেন। আমি এখন এ সব নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’ তবে দলের অন্দরের খবর, তৃণমূলের একাংশ ১৭ আসন নিয়ে বোর্ড গড়ার বিরুদ্ধে। অন্য অংশ অবশ্য নান্টু পালকে মেয়র হিসেবে তুলে ধরে সব বাম বিরোধীদের নিয়ে এগোতে চাইছে। নান্টুবাবু বলেন, ‘‘তৃণমূল-সহ সব বাম বিরোধীদের আসন সংখ্যা ২৪টি। শহরের সিংহভাগ মানুষের রায় বামেদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। কাজেই বামেদের বোর্ড চালানোর রায় দেওয়া হয়েছে বলে কেউ ভাবলে তা ঠিক হবে না।’’
ভোট শেষ। ফলও প্রকাশ্যে। শিলিগুড়ি কিন্তু সরগরম!