সারদা-কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়েও কেলেঙ্কারির আশঙ্কা!
গত বছর এপ্রিলে কেলেঙ্কারি ফাঁসের পরেই তড়িঘড়ি লগ্নিকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সে জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ৫০০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কেলেঙ্কারির তদন্তে রাজ্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করেছিল, তার মূল দায়িত্বই ছিল ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানো। ২২ অক্টোবর সেই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ বার প্রিন্সিপ্যাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি) রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে কমিশন কাদের টাকা দিয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারদার আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ ঘোষণার সময়েই আপত্তি তোলেন বিরোধীরা। আইনজ্ঞরাও বলেছিলেন, জনগণের টাকায় বেসরকারি সংস্থার হাতে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দেওয়া যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, হায়দরাবাদে সত্যম কম্পিউটার্সের কেলেঙ্কারিতে সারদা-কাণ্ডের থেকে অনেক বেশি লগ্নিকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। টাকার অঙ্কেও তছরুপের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার কোষাগারের টাকায় ক্ষতিপূরণ দেয়নি।
মুখ্যমন্ত্রী তখন এই সব যুক্তি মানেননি। উল্টে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে সিগারেটের উপরে বাড়তি কর বসান। রাজ্যবাসীকে পরামর্শ দেন আরও বেশি করে সিগারেট খেতে!
শ্যামল সেন কমিশন সূত্রে পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, টাকা ফেরত চেয়ে আবেদন করেন সারদার মোট সাড়ে ১২ লক্ষ আমানতকারী। গোড়ায় ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত যাঁরা জমা রেখেছিলেন, তাঁদের নাম বাছাই করে টাকা ফেরত দেওয়া হয়। এর পর দফায় দফায় ১০, ১৫ ও ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আমানতকারীদের বাছাই করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৪ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩৪৫। ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার মোট ২৮৬ কোটি বরাদ্দ করেছিল। চেক বিলি হয় ২৫১ কোটির।
হিসেবটা এখানেই শেষ নয়। বাছাই করা আমানতকারীদের মধ্যে যে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার জনকে চেক পাঠানো হয়েছিল, তাদের অনেকেকেই আবেদনপত্রে দেওয়া ঠিকানায় খোঁজ মেলেনি। ফলে ফেরত এসেছে প্রায় ১০৩ কোটির চেক। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের বাছাই করার আগে যথেষ্ট খোঁজখবর করা হয়েছিল কি? নাকি উদোর চেক বুধো নিয়ে চম্পট দিল? এমনকী, সারদায় টাকা না-রেখেও কেউ ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এই অবস্থায় পিএজি-র অডিট বিভাগের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কমিশনের টাকা খরচের বিস্তারিত হিসেবের পাশাপাশি আবেদনকারীদের দাবির সত্যতা ভাল ভাবে যাচাই করা হয়েছিল কি না, তা-ও জানতে চেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র দফতর অবশ্য এই হিসেবনিকেশের যাবতীয় দায় অর্থ দফতরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের যুক্তি, বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে গঠিত ও পরিচালিত হয় ঠিকই। কিন্তু সারদা কমিশন বিচারবিভাগীয় কমিশন নয়। সেটি গঠনের সময়ই জানানো হয়েছিল যে, অর্থ দফতরই তার যাবতীয় কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে। সেই কারণে অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে পিএজি-র চাওয়া যাবতীয় তথ্য জোগাড় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আর তাতেই ফাঁপরে পড়েছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, কমিশন যখন যে রকম টাকা চেয়েছে, তা মঞ্জুর করা ছাড়া অর্থ দফতরের কোনও ভূমিকা ছিল না। কমিশনকেই স্বাধীন ভাবে টাকা খরচের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এখন কমিশন নেই। ফলে জবাবদিহির দায় তাঁদের। প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেনও পিএজি-র চিঠির প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি আর এর মধ্যে নেই। যা রিপোর্ট দেওয়ার দিয়ে দিয়েছি। এ বার সরকার বুঝবে।”
কী ভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা বিলি করেছে সারদা কমিশন?
অর্থ দফতর এবং কমিশন সূত্রের খবর, কমিশন গঠনের পরে ক্ষতিগ্রস্তরা নথিপত্র-সহ ক্ষতিপূরণের আবেদন জমা করেছিলেন কমিশনে। একটি বেসরকারি ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে দিয়ে কমিশনই আবেদনকারীদের নামের তালিকা তৈরি করে। তার পর সেই তালিকা পাঠানো হয় বিধাননগর কমিশনারেটে রাজ্য সরকারের গড়া বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) কাছে। তাদের দায়িত্ব ছিল সারদার নিজস্ব নথি খতিয়ে দেখে আমানতকারীর দাবির সত্যতা যাচাই করা।
অর্থ দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, সিটের তরফে বিধাননগর কমিশনারেটের প্রধান অর্ণব ঘোষ প্রায় ৫ লক্ষ নামের তালিকা দফতরে পাঠিয়েছিলেন। সেই তালিকাই কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কমিশন যখন যে টাকা চেয়েছে, বিনা প্রশ্নে দিয়ে দেওয়া হয়েছে তা-ও। আবেদনকারীদের তালিকা ঠিক কি না, পুলিশের যাচাইয়ে কোনও গলদ আছে কি না কিছুই তাদের জানা নেই।
কিন্তু অর্থ দফতরের নিয়ম অনুযায়ী, টাকা মঞ্জুরের সময়ই দেখে নিতে হবে, সেই টাকা কোথায়, কী ভাবে যাচ্ছে এবং তার ব্যবহার হবে কি না। সারদা কমিশনের টাকা ছাড়ার সময় এ সব দেখা হয়নি বলেই অর্থ দফতরের কর্তাদের দাবি। তাঁদের এক জনের কথায়, “সাপ-ব্যাঙ যা থাকত, পাঠিয়ে দিতাম। অত্যন্ত সংবেদনশীল ফাইল নিয়ে বাড়তি উৎসাহ বা আইন ফলানোর কোনও সুযোগ ছিল না।”
কিন্তু সিটের তালিকা যে ত্রুটিমুক্ত ছিল না, তা অর্থ দফতরের অনেকেরই নজর এড়ায়নি। তালিকার নমুনা পরীক্ষা করে এক নাম একাধিক বার আছে, এমন অনেক নজির মিলেছিল বলে জানাচ্ছেন বাজেট বিভাগের এক আধিকারিক। কিন্তু নবান্নের উপর তলার চাপে টাকা ছাড়া নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। এখন পিএজি বিস্তারিত তথ্য চেয়ে পাঠানোয় অনেক গরমিল ধরা পড়বে বলে আশঙ্কা দফতরে।
নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তড়িঘড়ি টাকা দিতে হওয়ায় আবেদনকারীদের দাবি ঠিক কি না, তা খতিয়ে দেখার সময় পাওয়া যায়নি। সারদা গোষ্ঠী লগ্নিকারীদের টাকাকড়ির হিসেব রেখেছিল সাফারি নামে একটি সফটঅয়্যারের মাধ্যমে। এই সফটঅয়্যারে জালিয়াতি করে সংস্থার কোনও কোনও কর্মী টাকা নয়ছয় করেন, এমন অভিযোগ খোদ সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের। ফলে এই সফটঅয়্যার নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু টাকা ফেরত দেওয়ার সময় এই সফটঅয়্যারে থাকা তথ্যও অনেক ক্ষেত্রে যাচাই করা হয়নি বলে খবর।
দ্বিতীয়ত, যাঁরা আবেদন করেছেন তাঁদের ঠিকানা, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর যাচাই করার কথা ছিল সিটের। কিন্তু সারদার সাড়ে ১২ লক্ষ আবেদনকারীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই তথ্য যাচাই হয়নি বলেই অর্থ দফতরের কর্তারা জেনেছেন। তাই ফিরে এসেছে প্রায় একশো কোটি টাকার চেক। সংশয় দেখা দিয়েছে, যাঁরা টাকা পেলেন, তাঁদের সবাই প্রকৃত আমানতকারী কি না, তা নিয়েও। ফলে এখন পিএজি-র আতসকাচের নীচে সেই সব তথ্য রাখলে বড়সড় দুর্নীতি সামনে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
এ দিন বারবার চেষ্টা করেও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বা অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁরা টেলিফোন ধরেননি, এসএমএস-এরও জবাব দেননি।