ফের তৎপরতা সিঙ্গুরে। এ বার আর কারখানা গড়ার নয়, ভাঙার। চাষিদের জমি ফেরাতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরদিনই টাটা প্রকল্প এলাকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সদলবল এলেন হুগলির জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল এবং পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী। বৃহস্পতিবার দুপুরে দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।
সিঙ্গুরের জমি ফের চাষের উপযুক্ত করেই চাষিদের ফেরত দেবে রাজ্য। কী ভাবে সেই কাজ হবে, তার রূপরেখা তৈরি করতে বৃহস্পতিবার দুপুরে নবান্নে একাধিক মন্ত্রী ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিকেলের পরেই জারি করে দেওয়া হয় এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘আমরা জমি চাষযোগ্য করে ফেরত দেব। আদালতের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানবে সরকার।’’ সিঙ্গুর জমিরক্ষা কমিটির হিসেব মতো, ন্যানো প্রকল্প এলাকায় ৯৯৭ একর জমির মধ্যে ৫০০ একরেরও বেশি জমি এখনই চাষযোগ্য রয়েছে। বাকি এলাকায় কোথাও রয়েছে মূল কারখানার শেড, কোথাও বিদ্যুতের সাবস্টেশন, কোথাও রাস্তা, কোথাও খাল। সেই সব নির্মাণ ভেঙে, খাল বুজিয়ে কী ভাবে জমি চাষযোগ্য করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে প্রশাসনের অন্দরেই।
তবে নবান্নের একটি সূত্র বলছে, আপাতত চাষিদের জমির সীমানা নির্দিষ্ট করাই মূল কাজ। তার পরে নির্মাণ ভাঙা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে। বস্তুত, কারখানার মূল শেড-এ এখনই হাত দিতে চাইছে না প্রশাসন। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এ নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। টাটারাও ফের আদালতে যেতে পারে। তাই আগ বাড়িয়ে সরকার কিছু করবে না।’’ ওই কর্তা জানান, প্রথমে ওই শেড-এর আশপাশের কিছু কাঠামো ও দু’-একটি পুরনো বেসরকারি কারখানার নির্মাণ ভাঙা হবে। এমনকী, ন্যানো কারখানার জন্য তৈরি দু’টি বিদ্যুৎ সাবস্টেশনও ভেঙে দেওয়া হবে। দেখা হবে তার ফলে কী প্রতিক্রিয়া হয়। এ দিন মমতাও বলেন, ‘‘সরকারের যে সব কাঠামো রয়েছে, প্রথমে সেগুলি ভাঙা হবে।’’ শেড ভাঙা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি মুখ্যমন্ত্রী।
প্রকল্প এলাকার পুকুরে চলছে মাছ ধরা। ছবি: দীপঙ্কর দে।
নবান্নের অন্দরে দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, জমি চাষযোগ্য করে তোলার বিপুল খরচ কোথা থেকে আসবে? নবান্ন সূত্র বলছে, এ দিনের বৈঠকে প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, এই কাজকে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। এই প্রকল্পের টাকা অনেকটাই দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে রাজ্যের কোষাগারে তেমন চাপ পড়বে না। কিন্তু শুধু শ্রমিক লাগিয়ে নির্মাণ ভেঙে জমি চাষযোগ্য করা সম্ভব নয়। জেলা প্রশাসন জানাচ্ছে, মাটির নীচের কংক্রিট ও উপরের কাঠামো ভাঙার জন্য দক্ষ একাধিক বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ করা হবে। তা ছাড়া, ওই জমি উঁচু করার জন্য প্রচুর পরিমাণে বালি এবং ফ্লাই অ্যাশও ফেলা হয়েছিল। সে সব তুলে ফেলে অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে ফেলতে হবে। তবেই ফের চাষযোগ্য করা যাবে ন্যানো কারখানার জমি। ফলে রাজ্যের ঘাড়ে খরচের ধাক্কা থেকেই যাচ্ছে।
সে জন্য অবশ্য পিছপা হতে নারাজ মমতার সরকার। আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যেই যাতে জমি ফেরত দেওয়া যায়, তার জন্য ময়দানে নেমে পড়েছে রাজ্য প্রশাসন। আজ, শুক্রবার থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে জমি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া। ভূমিসচিব মনোজ পন্থকে এ দিনই সিঙ্গুরে পাঠান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী
বলেন, ‘‘আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। আমি নিজে সাত দিন কলকাতায় থাকব না। কিন্তু কাজ যাতে দ্রুত হয়, তার জন্য প্রতিদিন এক জন মন্ত্রী সিঙ্গুরে হাজির থাকবেন।’’ মমতা জানান, চাষিদের জমি ফেরত দেওয়ার আগে সমীক্ষা করতে হবে। কার, কত জমি অধিগ্রহণ করা হয়ছিল, তার নথি প্রশাসনের কাছে থাকলেও আবার তা দেখতে হবে। দু’সপ্তাহের মধ্যে ওই সমীক্ষা শেষ করা হবে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, জমি সংক্রান্ত নথিপত্র খতিয়ে দেখার পরে শুরু হবে সরেজমিন সমীক্ষার কাজ। এর জন্য এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছেন মমতা। নবান্নের এক কর্তা বলেন, ‘‘জমির আল মুছে গিয়েছে। ফলে কোন জমি কার, প্রথমে তা চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি, প্রত্যেকের জমির সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। কোনওটাই সহজ কাজ নয়। সেই জন্য জমি চিহ্নিত করার কাজে চাষিদেরও প্রশাসনের পাশে দাঁড়াতে বলা হয়েছে।’’ যাঁদের
জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল,
তাঁদের ব্লক অফিস ও ব্লক ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে বলেছে জেলা প্রশাসন।
তবে চাষিরাই যে কেবল জমি ফেরত পাবেন, তা নয়। মমতা বলেন, ‘‘বর্গাদার হিসেবে সরকারি খাতায় যাঁদের নাম নথিভুক্ত ছিল, আমরা তাঁদেরও জমির অধিকার ফিরিয়ে দেব।’’ পাশাপাশি তাঁদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে ভূমি সংস্কার আইনে। সেই আইন অনুযায়ীই বর্গাদারদের ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। এ দিনের বৈঠকে জমি ফেরতের প্রক্রিয়া দেখভাল করার জন্য কার্যত একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী তৈরি করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জমি ফেরতের প্রক্রিয়ায় যে সব দফতর যুক্ত, মূলত সেই মন্ত্রীদেরই সেখানে রাখা হয়েছে।
এখনই চাষ হতে পারে
•মৌজা জমি
• গোপালনগর ১০০
•খাসেরভেড়ি ৪০
• বেড়াবেড়ি ২৮০
(জয়মোল্লা সমেত)
•বাজেমিলিয়া ১১
• সিংহেরভেড়ি ২০
•সানাপাড়া ৮০
•খালের দক্ষিণে
মোট ৫৩১
হিসেব একরে (সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটির দেওয়া আনুমানিক হিসেব)