কারিগড়: বারুইপুরের একটি কারখানায় তৈরি হচ্ছে অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃিত সামগ্রী। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত (সার্জিক্যাল) সামগ্রী তৈরিতে গোটা দেশে বিখ্যাত ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর। সেখানকার গ্রামীণ এলাকার ঘরোয়া কারখানায় তৈরি সার্জিক্যাল সামগ্রী ব্যবহৃত হত দেশের বড় বড় হাসপাতালে। সেই ছবি বদলে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। বর্তমানে এই শিল্প ধুঁকছে। সরকারি তরফে চেষ্টা হলেও, তা কার্যকর হয়নি বলেই অভিযোগ। গ্রামীণ এই শিল্প আদৌ বাঁচবে কি না, পঞ্চায়েত ভোটের আগে সেই প্রশ্ন তুলছেন এলাকার মানুষ।
বহু বছর আগে ব্রিটিশ আমলে কিছুটা ঘটনাচক্রেই বারুইপুরে অস্ত্রোপচারের সামগ্রী তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সেই সময়ে বিভিন্ন এলাকায় রেলপথ তৈরি হচ্ছিল। রেলপথে ব্যবহারের জন্য বিশেষ এক ধরনের লোহার গজালের চাহিদা ছিল খুব। বারুইপুরের কল্যাণপুর ও সংলগ্ন কিছু এলাকার মানুষ কামারশালা খুলে ওই গজাল তৈরির কাজ শুরু করেন। সেই সময়ে এক ব্রিটিশ চিকিৎসকের ঘোড়ার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার প্রয়োজনীয় যন্ত্র এ দেশে মিলত না। কল্যাণপুরের এক ব্যক্তি বিবরণ শুনে তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিজের কামারশালায় সেই যন্ত্র বানিয়ে দেন। যা খুবই পছন্দ হয় ওই ব্রিটিশ চিকিৎসকের। পরবর্তী কালে কল্যাণপুরের ওই ব্যক্তি আরও যন্ত্র তৈরির বরাত পেতে শুরু করেন। এ ভাবেই স্থানীয় কামারশালায় শুরু হয় অস্ত্রোপচারের সামগ্রী তৈরির কাজ। ক্রমশ আশপাশের কামারেরাও এই কাজে হাত লাগান।
ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হয়। পরবর্তী ৫০ বছরে সার্জিক্যাল শিল্পের হাত ধরে এই এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতিতে আমূল বদল আসে। বারুইপুরের কল্যাণপুর পঞ্চায়েত এলাকাকে সার্জিক্যাল শিল্পের আঁতুড়ঘর ধরা হয়। সেখানে কার্যত ঘরে ঘরে অস্ত্রোপচারের সামগ্রী তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। আশপাশের পঞ্চায়েতগুলিতেও শুরু হয় কাজ। ক্রমশ প্রায় পাঁচ-সাতশো ছোট-বড় কারখানা তৈরি হয় এলাকায়। শুরু হয় কয়েকশো ধরনের অস্ত্রোপচারের সামগ্রী তৈরি। সেই সামগ্রী সরবরাহ শুরু হয় দেশে, দেশের বাইরেও। বদলে যায় এলাকার কর্মসংস্থানের চিত্র। বারুইপুর-সহ আশপাশের এলাকার বহু তরুণ সার্জিক্যাল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। কারিগরি উৎকর্ষতার দিক থেকেও এখানকার তৈরি সামগ্রী এগিয়ে ছিল অনেকটাই। কিন্তু পরবর্তী কালে কমতে কমতে এখন কার্যত ধ্বংসের মুখে সার্জিক্যাল শিল্প। বর্তমানে এলাকায় কারখানার সংখ্যা একশোরও কম। বড় কারখানা হাতে গোনা। নতুন প্রজন্ম আর এই কাজে আসছে না।
কেন পিছিয়ে পড়ছে এই শিল্প? শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন জানান, লোহা বা ইস্পাত থেকে এক-একটি সামগ্রী তৈরির মূলত দু’টি ধাপ। একটি ধাপে প্রযুক্তির সাহায্য লাগে। অন্য ধাপটি শৈল্পিক নৈপুণ্য ও কারিগরি দক্ষতার উপরে নির্ভরশীল। কারিগরি দক্ষতায় বরাবরই এগিয়ে বারুইপুরের শিল্পীরা। কিন্তু, তাঁরা মার খাচ্ছেন প্রযুক্তিগত দিকে। গ্রামের ছোট কারখানায় বসে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্র ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না।
শিল্পীরা জানান, উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। তা সরকারি সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার শিল্পীরা সরকারি সাহায্যের আবেদন করে আসছেন। বাম আমলে কেন্দ্রের সহযোগিতায় একটি ভবন তৈরি করে কিছু যন্ত্র কিনে শিল্পীদের সাহায্য করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের এনে প্রযুক্তিগত সাহায্যের পরিকল্পনাও হয়েছিল। কিন্তু আখেরে তেমন লাভ হয়নি বলে অভিযোগ।
২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে সার্জিক্যাল শিল্প বাঁচাতে নতুন করে উদ্যোগী হয়। বহু টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’। কিন্তু এত দিনেও সেই কেন্দ্র চালু হয়নি। যদিও প্রশাসন সূত্রের দাবি, আধুনিক যন্ত্রপাতি-সহ ওই কেন্দ্র প্রায় তৈরি। যত শীঘ্র সম্ভব সেটি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সার্জিক্যাল শিল্পীদের সংগঠনের সহ-সভাপতি প্রদোষ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের কারিগরদের তৈরি সামগ্রী কম দামে কিনে তাতে সামান্য প্রযুক্তির ছোঁয়া দিয়ে চড়া দামে বাজারে ছাড়ছে বিদেশি সংস্থা। আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি। পূর্ণ সরকারি সহযোগিতা পেলে শুধু এই এলাকা থেকে এই শিল্পকে কেন্দ্র করেই বছরে ২০০ কোটির মুনাফা সম্ভব। কিন্তু এই শিল্প বাঁচাতে সরকারের তেমন সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না।’’